ট্রেন আবিষ্কারের ইতিহাস
ফ্রান্সে নিকোলাস কুনো নামে ছিলেন এক ইঞ্জিনিয়ার। ইঞ্জিনের সাহায্যে গাড়ী চালানো যেন পেয়ে বসলো তাঁকে। শেষে একদিন আবিষ্কার করলেন একটি তিন চাকার গাড়ী। পেছনে বয়লার রেখে বয়লারের বাম্পকে নিয়োগ করলেন চাকা ঘোরানোর কাজে।
কুনোর দীর্ঘকালের প্রচেষ্টা সফল হলো। ঘন্টায় চারমাইল গবিবেগ নিয়ে চলতে শুরু করলো গাড়ী। উৎসাহিত কুনো একদিন দু-একজন বন্ধুকে নিয়ে চেপে বসলেন গাড়ীতে। কিন্তু দুর্ভাগ্য কুনোর। গাড়ী চলতে চলতে একসময় ধাক্কা খেল রাস্তার ধারে একটা দেওয়ালের গায়ে। বয়লার গেল ফেটে এবং কুনোসহ যাত্রীরা ছিটকে পড়লেন।
আঘাত গুরুতর না হওয়ায় সেদিন প্রাণে রক্ষা পেয়েছিলেন সবাই। তবে সংবাদটা ছড়িয়ে পড়ায় আতঙ্কিত হয়ে উঠেছিলেন অনেকে। ধারণা হয়েছিল, গাড়ী একটা বিপজ্জনক জিনিস। ওতে আরোহণ করলে যে কো সময়ে বেঘোরে প্রাণটা যাবে।
কুনোর ঐ গাড়ী চালানোর ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত সরকার অবধি গড়িয়েছিল এবং সরকার জনমতের চাপে গাড়ী তৈরির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। আর বেচারা কুনো, শুধুমাত্র তাঁর গাড়ীটাকে বাজেয়াপ্ত করা হয়নি, তাঁকেও পুরে দেয়া হয়েলিছ জেলখানার ভেতরে।
কুনোর পরে আর একজন ইঞ্জিনিয়ার আর একটি বিশেষ ধরণের গাড়ীর ইঞ্জিন তৈরি করেছিলেন। তার নাম উইলিয়াম মার্ডক। এটি ছিল কুনোর ইঞ্জিনের চেয়ে অনেক উন্নত এবং এটিকে রেল ইঞ্জিনের প্রাথমিক রূপ বলা যায়।
গাড়ীর প্রতি জনসাধারণের ভীতির জন্য মার্ডক দিনের বেলায় তাঁর ইঞ্জিনকে বার করতে সাহস করেননি। নিশুতিরাতে সবাই যখন গাঢ় ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল, ঠিক সেই সময় বার করেছিলেন ইঞ্জিনটি। কিন্তু ইঞ্জিনের প্রচন্ড শব্দে স্থানীয় সমস্ত মানুষের ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল। তারা জেগে ওঠে দেখে, ক্রুদ্ধ আক্রোশে ফুঁসতে ফুঁসতে কুচকুচে কালো, বিরাট দৈত্যের মত কী একটা গণগণে আগুন এবং রাশি রাশি গাঢ় ধোঁয়া ছড়াতে ছড়াতে এগিয়ে আসছে? দেখা মাত্রই শিউরে উঠেছিল সবাই। কোন এক শয়তানের কীর্তি মনে করে তারা ঘরের দোর বন্ধ করে কাঁপতে শুরু করেছিল।
এদিকে ইঞ্জিনটা যখন বড় রাস্তা বেয়ে গির্জার কাছে এসে পড়লো, তখন পাদ্রী সাহেবের ভেঙ্গে গেল। তিনি ধরে নিলেন, দেশের মানুষের মধ্যে অনাচার এসেছে। তাই তাদের শায়েস্তা করার জন্য ঈশ্বর প্রেরণ করেছেন শয়তানকে। আর শয়তান মশাল জ্বেলে পথ পরিক্রমা করছে। ঈশ্বরকে সন্তুষ্ট করতে না পারলে অচিরে পৃথিবীটা একেবারে ধ্বংস হয়ে যাবে।
একটিবার মাত্র পথ পরিক্রমা করে মার্ডক ইঞ্জিন বন্ধ করে দিলেন। কিন্তু সে রাতে দেখা সেই ভয়ঙ্কর শয়তানের কথাই আলোচনা করতে লাগলেন সবাই। আর শয়তানটা কোথা আত্মগোপন করে আছে তা জানার জন্য সবাই উদগ্রীব হয়ে রইলো।
শেষে আবিষ্কৃত হলো কাজটা শয়তানের নয়-মার্ডকের। তখন পাদ্রী সাহেব ধরে নিলেন, মার্ডকের দেহেই শয়তান ভর করেছে এবং ঐ মার্ডককে শয়তানমুক্ত করতে না পারলে দেশের চরম সর্বনাশ হবে।
মার্ডকের পরিণাম কুনোর মত না হলেও, গাড়ী আর চালাতে পারলেন না তিনি। কিন্তু যারা এ বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করতেন তারা বুঝতে পারলেন, ইঞ্জিনের দ্বারা প্রচুর মালপত্রকে বহন করে নিয়ে যাওয়া আদৌ কষ্টসাধ্য ব্যাপার নয়। তাছাড়া অনেক শক্তিশালী করে গড়ে তোলা যায় ইঞ্জিনকে। তাই জনগণের রোষ এবং সরকারের রোষকে তুচ্ছ করেও গবেষকরা গোপনে গোপনে চালিয়ে গেলেন গবেষণা।
কেটে গেল আরও কিছুদিন। একসময় ইংল্যান্ডের ম্যাঞ্চেষ্টার থেকে লিভারপুল পর্যন্ত পাতা হলো রেল লাইন। উদ্দেশ্য ছিল লোহার পাতের উপর দিয়ে ঠেলা গাড়ীতে করে একটু সহজে বয়ে নিয়ে যাবে কয়লাকে। সেখানকার কয়লার খনিতে কাজ করতেন এক ইঞ্জিনিয়ার। নাম তাঁর জর্জ স্টিফেনসন। তিনি কর্তৃপক্ষকে জানালেন, যদি আর্থিক আনুকুল্য লাভ করেন, তাহলে ইঞ্জিনের সাহায্যে তিনি অল্প সময়ে শ শ টন কয়লাকে যথাস্থানে পৌছে দিয়ে আসতে পারবেন। শত শত মানুষ এবং শত শত ঠেলাগাড়ি দরকার হবে না।
কর্তৃপক্ষ ভেবে দেখলেন, স্টিফেনসন যদি কৃতকার্য হন, তাহলে প্রচুর খরচ বেঁচে যাবে এবং লাভের অঙ্কটা দাঁড়াবে বিশগুণ। তাই নির্দেশ দিলেন স্টিফেনসনকে এবং কিছু অর্থও বরাদ্দ করলেন।
স্টিফেনসন একসময় গাড়ী তৈরি করে ইঞ্জিন জুড়ে দিলেন। দিনও স্থির হয়ে গেল। আর কথাটাও রটে গেল চারদিকে। শত শত টন কয়লাকে বোঝাই করে ছুটবে গাড়ী- সে আবার কেমন গাড়ী! দূর-দূরান্ত থেকে হাজার হাজার দর্শক ছুটে এলো সেই অদ্ভুত ও অত্যাচার্য গাড়ীটিকে দেখার জন্য। পথের দুপাশে জনতার ভিড় একেবারে উপচে পড়লো।
যথাসময়ে স্টিফেনসন গাড়ীতে স্টার্ট দিলেন। হুস হুস করে ধোঁয়া ছড়াতে ছড়াতে এগিয়ে চললো গাড়ী। পথের জনতাকে সাবধান করে দেয়ার জন্যে সামনে লাল নিশান হাতে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেন এক অশ্বারোহী। কিন্তু গাড়ীর গতি ধীরে ধীরে এমন বেড়ে উঠলো যে, ঘোড়া তার সাথে পাল্লা দিতে পারলো না। বাধ্য হয়ে অশ্বারোহীকে পথ ছেড়ে দিতে হলো। আর নির্দিষ্ট সময়ের ঢের আগেই গন্তব্যস্থলে পৌঁছে গেল গাড়ী।
ফেরার পথে দর্শকদের আগ্রহাতিশয্যে স্টিফেনসন বহুজনকে গাড়ীতে করে নিয়ে এসেছিলেন। গাড়ীর এমন তীব্র গতি দেখে সবাই সেদিন বিষ্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। গতির যে একটা আনন্দ আছে, তাও সেদিন প্রথম মানুষ বুঝতে পেরেছিল।
এমন গতিসম্পন্ন গাড়ীকে সেকালে মানুষ কিন্তু সহজে মেনে নিতে পারেনি। ভীত হয়ে উঠেছিলেন প্রতিটি মানুষ। এমনটি পার্লামেন্টের সদস্যরাও শঙ্কিত হয়ে উঠেছিলেন। প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন, রাস্তায় ইঞ্জিন চলাচল করলে পথের দুপাশের গ্রামগুলো পুড়ে ছাই হয়ে যাবে, গরু-বাছুর কাটা পড়বে, পুকুরের পানি দূষিত হয়ে উঠবে এবং মাঠে ফসল ফলবে না। খনির মালিক এবং স্টিফেনসনের সর্বনাশা বুদ্ধির জন্য বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল সারাদেশ। দ্বিতীয়বার যাতে এই গাড়ীকে স্টিফেনসন বার করতে না পারেন, তার জন্য কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যও সরকারের উপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল। কিন্তু গাড়ী চালানো বন্ধ রাখা হয়নি। ধীরে ধীরে সবাই মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল।
প্রকৃতপক্ষে রেলগাড়ীর প্রচলন সেই থেকেই। আর এভাবেই রেলগাড়ি বা ট্রেন আবিষ্কার হয়।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions