প্রবন্ধ কাকে বলে
‘প্রবন্ধ’ শব্দের অর্থ ‘প্রকৃষ্ট বন্ধন’। এ বন্ধন হচ্ছে ভাব ও ভাষার বন্ধন। ভাষাকে অবলম্বন করে ভাব প্রকাশিত হয়। ভাবকে বহনও করে ভাষা। তাছাড়া ভাব অনুযায়ী ভাষা তার চেহারা ও রূপেরও পরিবর্তন ঘটায়। ভাব গুরুগম্ভীর হলে ভাষা সে-অনুযায়ী গুরুগম্ভীর হয়। ভাব হালকা চটুল হলে ভাষা হয় হালকা চটুল। ভাব-ভাষার বন্ধন যথাযথ হলে সে রচনা-দেহে সাহিত্যগুণের বিকাশ ঘটে। ভাব-ভাষার সঙ্গে যথোপযুক্ত তথ্য, তত্ত্ব, দৃষ্টান্তের প্রয়োগে বক্তব্য বিষয় সবিসত্মারে সাজিয়ে নিলে প্রবন্ধের সুঠাম সংহত অবয়বটি গড়ে ওঠে। সুতরাং কোনো মননশীল ভাব কিংবা তথ্য বা তত্ত্ব উপযুক্ত ভাষার মাধ্যমে যুক্তি-পরম্পরায় সুসংহতভাবে প্রকাশিত হয়ে শিল্পরূপ লাভ করলে আমরা তাকে প্রবন্ধ বলতে পারি। প্রবন্ধ যে সবসময় মননশীল ও যুক্তিধর্মীই হবে তা নয়। প্রবন্ধ অনুভূতিপ্রধান, আবেগধর্মী, বুদ্ধিদীপ্ত কিংবা অন্তরঙ্গ চিন্তাধর্মীও হতে পারে। ব্যক্তিভেদে প্রবন্ধের প্রকাশভঙ্গি, পরিবেশন-রীতি, যুক্তিপ্রয়োগের পদ্ধতি, বিশ্লেষণী ক্ষমতা প্রভৃতি ভিন্ন ভিন্ন হওয়া স্বাভাবিক। একই বিষয়ের প্রবন্ধ বিভিন্ন লেখকের রচনায় ভিন্ন ভিন্ন শিল্প-শৈলীতে প্রকাশিত হয়।
প্রবন্ধ ও নিবন্ধ
নিবন্ধ শব্দটি প্রবন্ধ শব্দের সমার্থক। প্রবন্ধ শব্দটি যেমন প্রকৃষ্ট রূপে বন্ধন তেমনি ‘নিবন্ধ’ শব্দটি সাধারণত সংস্কৃত অলংকার গ্রন্থে বন্ধনযুক্ত রচনা অর্থেই গ্রহণ করা হয়। অতএব সংজ্ঞা এবং কাঠামোগত দিক দিয়ে এদুয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। তবে নিবন্ধ প্রবন্ধের চেয়ে সংক্ষিপ্ত। বলা যায়- ভাবে, চিন্তায়, যুক্তিতে এবং শিল্পসম্মত সুঠাম গঠনে প্রবন্ধ ও নিবন্ধ একই, কিন্তু আয়তনে-আকারে-ব্যাপ্তিতে ও পরিসরে নিবন্ধ প্রবন্ধের তুলনায় সংক্ষিপ্ত। তাছাড়া নিবন্ধকে বিশেষ প্রয়োজনে মূল বক্তব্যের সারসংক্ষেপ উপস্থাপন কৌশলও বলা যায় । উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিবসে দৈনিক পত্রিকাগুলোয় ঐ দিনের তাৎপর্য তুলে ধরে নিবন্ধ ছাপা হয়।
প্রবন্ধের প্রকারভেদ
বিষয়মাত্রই চিরপুরাতন ও সীমাবদ্ধ; ভঙ্গিই তাকে চলিষ্ণু ও প্রাণবান করে তোলে। প্রবন্ধ-সাহিত্যের বিচারে তাই এই বিষয়বস্তু প্রকাশের ভঙ্গিই মুখ্য। বিষয়বস্তু ও প্রকাশভঙ্গির দিক থেকে প্রবন্ধ সাহিত্যকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-তন্ময় বা বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধ এবং মন্ময় বা ব্যক্তিনিষ্ঠ প্রবন্ধ।
তন্ময় বা বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধ
সাহিত্যের যা চিরন্তন উদ্দেশ্য- সৌন্দর্যসৃষ্টি ও আনন্দদান, তাই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য। ‘বস্তুনিষ্ঠ’ প্রবন্ধ আমাদের বুদ্ধিকে তীক্ষ্নতর, দৃষ্টিকে সমুজ্জ্বল ও জ্ঞানের পরিধিকে প্রশস্ত করে তোলে। বস্তুত; বিষয়বস্তুর প্রাধান্য রক্ষা করে যে সকল প্রবন্ধ লেখা হয় তাকে তন্ময় বা বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধ বলে। এ ধরনের প্রবন্ধকে চিন্তামূলক প্রবন্ধও বলা হয়। বিষয়বস্তুর গৌরবই এ ধরনের প্রবন্ধের মূল কথা। এ জাতীয় প্রবন্ধের মধ্যে লেখকের ব্যক্তিত্ব, জ্ঞান, বুদ্ধির প্রখরতা ফুটে ওঠে। তন্ময় প্রবন্ধের বিষয়বস্তু সাধারণত গুরুগম্ভীর ও তথ্যসমৃদ্ধ হয়। যেমন- ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর রচিত ‘বর্ণ পরিচয়’, ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘প্রাচীন সাহিত্য’, ‘আধুনিক সাহিত্য’ ইত্যাদি।
মন্ময় বা ব্যক্তিনিষ্ঠ প্রবন্ধ
মন্ময় প্রবন্ধে লেখকের ব্যক্তিচিন্তা অপেক্ষা ব্যক্তিহৃদয়ই প্রধান। অর্থাৎ এ ধরনের প্রবন্ধে ব্যক্তিই প্রধান, বস্তু নয়। রচনার রস সম্ভোগই এর মূল কথা। এ জাতীয় প্রবন্ধে লেখক আত্মনিবেদন করেন। মন্ময় প্রবন্ধের বিষয়বস্তু নির্বাচনে লেখকের যথেষ্ট স্বাধীনতা থাকে। এ ধরনের প্রবন্ধ ব্যক্তি জীবনের নানা জটিলতাকে আর বিষয়বস্তর গাম্ভীর্যকে আত্মগত ভাবরসে সিক্ত করে জীবনকে সরসতা ও স্নিগ্ধতা দান করে। বলার বিষয় নয়, বরং বলার ভঙ্গিই লেখকের নিকট প্রাধান্য পায়। যেমন- বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কৃষ্ণচরিত্র’, ‘কমলাকান্তের দপ্তর’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘জীবন স্মৃতি’, ‘ছেলে বেলা’, ‘ছিন্নপত্র’, প্রমথ চৌধুরীর ‘তেল নুন লাকড়ি’, কাজী নজরুল ইসলামের ‘আমি ঙসনিক’, প্রভৃতি।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions