ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উৎপাদন বিধি
ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উৎপাদন বিধি (Law of Diminishing Return): অন্যান্য উপকরণকে স্থির রেখে কোন একটি উপকরণের নিয়োগ বাড়াতে থাকলে একটি পর্যায়ের পরে অতিরিক্ত প্রতিটি একক থেকে প্রাপ্তির হার বা উৎপাদনের হার হ্রাস পেতে থাকে - এটাকেই বলা হয় ক্রমহ্রাসমান প্রান্তির উৎপাদন বিধি। যেমন জমিতে ক্রমাগতভাবে শ্রম ও মূলধন নিয়োগ করা শ্রম ও মূলধন যে হারে বৃদ্ধি পায় উৎপাদন সে তুলনায় কম হারে বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ প্রান্তিক উৎপাদন এবং গড় উৎপাদন ক্রমশ: হ্রাস পায়। এই বিধি ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উৎপাদন বিধি নামে পরিচিত। অধ্যাপক মার্শালের সংজ্ঞা এখানে বিশেষভাবে উলে-খযোগ্য। তার ভাষায় - “An increase in capital and labour applied in the cultivation of land causes in general a less than proportionate increase in amount of produced raised.” অর্থাৎ- ‘‘কোন নির্দিষ্ট পরিমাণ জমিতে চাষের জন্য অধিক হারে শ্রম ও মূলধন নিয়োগ করতে থাকলে সাধারণত; আনুপাতিক হার অপেক্ষা কম হারে উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।’’
কৃষিক্ষেত্রে যেহেতু জমির যোগান স্থির অথচ লোকসংখ্যা ক্রমাগতভাবে বেড়েই চলছে তাই প্রাচীন অর্থনীতিবিদগণ ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক বিধিটি কৃষিক্ষেত্রে অধিক প্রযোজ্য মনে করতেন। বর্ধিত জনগোষ্ঠির জন্য খাদ্যের যোগান দিতে একই জমিতে অধিক পরিমাণ শ্রম ও মূলধন নিয়োগ করা হয়। ফলে মোট উৎপাদন বৃদ্ধি পায়, কিন্তু শ্রম ও মূলধন বৃদ্ধির আনুপাতিক হারের চেয়ে কম হারে। অর্থাৎ খরচের তুলনায় উৎপাদন ক্রমশঃ হ্রাস পেতে থাকে। উৎপাদন বিধির এই নিয়মকে ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উৎপাদন বিধি বলে।
বিধিটির ব্যতিক্রমঃ
ক্রমহ্রাসমান উৎপাদন বিধির ব্যতিক্রমগুলি নিম্নরূপঃ
১) উৎপাদনের প্রাথমিক পর্যায়েঃ উৎপাদনের প্রথম স্তরে ক্রমহ্রাসমান উৎপাদন বিধিটি কার্যকরী নাও হতে পারে। প্রথম দিকে যদি শ্রম ও মূলধনের পরিমাণ কোন নির্দিষ্ট জমি উত্তমরূপে চাষের জন্য যথেষ্ট না হয় তবে অতিরিক্ত শ্রম ও মূলধনের নিয়োগ করা হলে প্রান্তিক উৎপাদন হ্রাস না পেয়ে বরং বৃদ্ধি পেতে পারে।
২) চাষ পদ্ধতির আধুনিকীকরণঃ ক্রমহ্রাসমান উৎপাদন বিধিটির কার্যকারীতা চাষ পদ্ধতির উপরও নির্ভর করে। কৃষিক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের করে ক্রমহ্রাসমান উৎপাদন বিধিটির প্রবণতা কিছুকালের জন্য স্থগিত রাখা যায়। উন্নত ধরনের চাষাবাদ, সেচ, বীজ ও সার ব্যবহারের ফলে উৎপাদন ক্রমহ্রাসমান হারে না বেড়ে বরং ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পেতে পারে।
৩) প্রাকৃতিক কারণঃ হঠাৎ কোন প্রাকৃতিক কারণে যদি জমির উর্বরতা বৃদ্ধি পায় তাহলে ক্রমহ্রাসমান উৎপাদন বিধিটি কার্যকরী হবে না।
৪) জমির পরিমাণ বৃদ্ধিঃ শ্রম ও মূলধন বৃদ্ধির সাথে সাথে যদি জমির পরিমাণ ও বৃদ্ধি পায়, তবে এ বিধিটি কার্যকরী হবে না।
৫) সকল উপাদানের একসঙ্গে বৃদ্ধিঃ যদি উৎপাদনের সকল উপাদান একই সঙ্গে বৃদ্ধি পায়, তবে এ বিধিটি কার্যকরী হবে না।
উপরোক্ত ক্ষেত্রসমূহে ক্রমহ্রাসমান উৎপাদন বিধিটি কার্যকরী হয় না। সাময়িকভাবে এই বিধিটির কার্যকারীতা স্থগিত থাকতে পারে কিন্তু এমন এক সময় আসবে যে ক্রমহ্রাসমান উৎপাদন বিধি কৃষিক্ষেত্রে কার্যকরী হবেই - এজন্য এ বিধিটি চূড়ান্ত বিধি। ক্রমহ্রাসমান উৎপাদন বিধিটি শুধুমাত্র কৃষি ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উৎপাদন বিধিটি যে কৃষিক্ষেত্রে প্রযোজ্য তা উপরোক্ত আলোচনা থেকে বুঝা যায়। তবে বিধিটি যে শুধুমাত্র কৃষিক্ষেত্রে প্রযোজ্য তা নয়, বরং উৎপাদনের সকল ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য। শিল্প প্রতিষ্ঠান, মৎস্যক্ষেত্র, খনিজক্ষেত্রসহ সকল উৎপাদন ক্ষেত্রেই বিধিটি প্রযোজ্য। নিম্নে এ সকল ক্ষেত্র নিয়ে আলোচনা করা হ’ল।
১) শিল্প ক্ষেত্রঃ শিল্প ক্ষেত্রেও ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উৎপাদন বিধি কার্যকরী হয় তবে প্রথম কয়েকটি ধাপ অতিক্রম করে অর্থাৎ বিলম্বে। কেননা, শিল্পক্ষেত্রে প্রথমদিকে ক্রমবর্ধমান প্রান্তিক উৎপাদন বিধি কার্যকরী হয়ে থাকে। শ্রম ও মূলধন বৃদ্ধির ফলে শিল্প অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক ব্যয় সংকোচের সুবিধাসমূহ পেতে পারে। ফলে একক প্রতি উৎপাদন খরচ কমে যায় এবং উৎপাদন বৃদ্ধি লাভজনক হয়। কিন্তু কোন কারখানার আয়তন সীমাহীনভাবে বৃদ্ধি করা যায় না। এমতাবস্থায়, একটি নির্দিষ্ট সময়ের পরে অধিক শ্রম ও মূলধন নিয়োগ করলে উৎপাদন ক্রমবর্ধমান হারে না বেড়ে ক্রমহ্রাসমান হারে বাড়তে থাকবে। সুতরাং দেখা যায় যে, দীর্ঘকালীন সময়ে শিল্প ক্ষেত্রেও ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উৎপাদন বিধি কার্যকরী হবে।
২) খনিজ ক্ষেত্রঃ খনিজ ক্ষেত্রেও ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উৎপাদন বিধি প্রযোজ্য। খনিজ পদার্থ যেমন কয়লা, লৌহ ইত্যাদি উত্তোলনের জন্য ক্রমশ: খনির গভীরে যেতে হয় এবং ওর মধ্যে আলো-বাতাসের ব্যবস্থা করতে হয়। কিন্তু এসব কাজ সম্পন্ন করাতে অনেক ব্যয় হয় এবং উৎপাদন ক্রমশঃ বৃদ্ধি পায়। কিন্তু ব্যয়ের তুলনায় উৎপাদন বৃদ্ধির হার কম হয়। এভাবে ক্রমহ্রাসমান উৎপাদনবিধি খনিজ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়।
৩) মৎস্য ক্ষেত্রেঃ মৎস্যক্ষেত্রেও ক্রমহ্রাসমান উৎপাদন বিধি কার্যকরী হয়ে থাকে। নদী, বিল, পুকুরের মত মৎস্যক্ষেত্রে ইচ্ছা করলেই বেশি মাছ ধরা যায় না। ক্রমাগতভাবে অধিক সংখ্যক মাছ ধরতে হলে বেশি পরিমাণ শ্রম, নৌকা, জাল ও আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের জন্য অধিক অর্থ ব্যয় করতে হয়। ফলে ধৃত মৎসের মোট পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে, কিন্তু মৎস্য সংগ্রহের হার মোট উৎপাদন ব্যয়ের তুলনায় কম হবে। সুতরাং মৎস্য ক্ষেত্রেও ক্রমহ্রাসমান উৎপাদন বিধিটি প্রযোজ্য।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions