বিচার বিভাগের কার্যাবলী
বিচার বিভাগ সরকারের প্রধান তিনটি বিভাগের একটি। তবে সরকারের অন্য দুইটি বিভাগ জনপ্রতিনিধি নির্ভর হলেও, বিচার বিভাগের ক্ষেত্রে তা ঘটে না। বিচার বিভাগ যে কোন রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণের প্রধান কাঠামো। এই বিভাগটি তত্ত্বগতভাবে রাজনৈতিক দল ব্যবস্থার উর্ধ্বে থেকে সর্বোচ্চ নিরপেক্ষতার ভিত্তি কাজ করে। অ্যালান বলের মতে, রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বিচার বিভাগের কার্যাবলির পরিমাণ বিশেষীকরণের মাত্রার (degree of specialization) উপর নির্ভরশীল। নিম্নে বিচার বিভাগের কার্যাবলি আলোচনা করা হল:
১। বিচার সংক্রান্ত কাজ: বিচার বিভাগের প্রধান কাজ হল দেশের প্রচলিত আইন ও সংবিধান অনুযায়ী নিরপেক্ষভাবে বিচারিক কার্য সম্পাদন করা। এ জন্য বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের প্রচলিত আইনকে বিশেষ ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে অপরাধীর দন্ডবিধান করে। আদালতে যে সকল মামলা-মোকদ্দমা দায়ের করা হয় সে সমস্ত মামলার বাদী-বিবাদীর সাক্ষ্য গ্রহণের পর আইনানুযায়ী নিরপেক্ষভাবে বিচারের রায় ঘোষণা করা বিচার বিভাগের অন্যতম কাজ। বিচার বিভাগ নির্ভীক, নির্লোভ ও নিরপেক্ষভাবে আইনগত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিচার করে অপরাধীর শাস্তি প্রদান ও নিরপরাধীকে মুক্তি প্রদানের মাধ্যমে রাষ্ট্রে ন্যায় বিচার ও আইনের অনুশাসন প্রতিষ্ঠা করে।
২। আইনের ব্যাখ্যা সংক্রান্ত কাজ: বিচার বিভাগ আইনসভা প্রণীত আইনের ব্যাখ্যা প্রদান এবং যথাযথভাবে তা প্রয়োগের ব্যবস্থা করে। বিচার বিভাগ যদি কোন আইনকে কিংবা আইনের ভাষাকে অস্পষ্ট বা পরস্পর বিরোধী বলে মনে করে তাহলে বিচারপতিগণ আইন প্রণেতাদের ধ্যান-ধারণা বিশ্লেষনের মাধ্যমে আইনের ব্যাখ্যা প্রদান করেন।
৩। আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত কাজ: অনেক সময় বিচার কার্য সম্পাদন করতে গিয়ে প্রচলিত আইন যথেষ্ট নয় বলে বিচারপতিরা মনে করতে পারেন। সেক্ষেত্রে বিচারাধীন কোন মামলার রায় দানকালে তারা আইনের উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেন। আইনের এই ব্যাখ্যা পরবর্তী সময়ে নজির হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এভাবে বিচারকগণ প্রচলিত আইনের ব্যাখ্যা প্রদানের মাধ্যমে নতুন আইনের সৃষ্টি করেন। এসব আইনকে ‘বিচারক প্রণীত আইন (Judgemade laws) বলা হয়।
৪। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা: ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা বিচার বিভাগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আদালতের সম্মুখে আনীত যেকোন বিরোধের নিষ্পত্তি করতে গিয়ে বিচারপতিদের বাস্তব ঘটনাবলি সম্পর্কে তথ্যাদি সংগ্রহ করতে হয়। এই উদ্দেশ্যে নথিপত্র, সাক্ষ্য-প্রমাণ ইত্যাদির সাহায্য গ্রহণ করা হয়। দেওয়ানী ও ফৌজদারী উভয় প্রকার মামলাতেই বিচার বিভাগকে | সত্যানুসন্ধানের মাধ্যমে অপরাধীর শাস্তি বিধান করে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পবিত্র কর্তব্য পালন করতে হয়।
৫। বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা ও সংবিধানের ব্যাখ্যা: আইনসভা প্রণীত কোন আইন কিংবা শাসন বিভাগের কোন আদেশ যখন সংবিধানের বিরোধী হয় তখন সেই আইন বা আদেশকে বাতিল করে দেওয়ার যে ক্ষমতা বিচার বিভাগের হাতে থাকে তাকে বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা (Judicial Review) বলা হয়। সংবিধান বিরোধী আইন বা নির্দেশ বাতিল করে দিয়ে বিচার বিভাগ সংবিধানের পবিত্রতা ও শ্রেষ্ঠত্ব রক্ষার গুরুদায়িত্ব পালন করে। তাছাড়া অনেক সময় বিচার বিভাগ সংবিধানের ব্যাখ্যা প্রদানের মাধ্যমে কোন বিরোধ নিষ্পত্তি কিংবা কোন আইনের বৈধতা বিচার করতে পারে ।
৬। পরামর্শ দানের ক্ষমতা: কোন কোন দেশে বিচার বিভাগ শাসন বিভাগ ও আইন বিভাগকে পরামর্শদান করে থাকে। ভারতবর্ষের সুপ্রীম কোর্ট সাংবিধানিক বিষয়ে রাষ্ট্রপ্রধানকে পরামর্শ দিতে পারে। তবে তিনি সুপ্রিম কোর্ট প্রদত্ত পরামর্শ গ্রহণ করতে বাধ্য নন ।
৭। শাসন সংক্রান্ত কাজ: বিচার বিভাগ বিচারিক কার্য ছাড়াও কিছু শাসন সংক্রান্ত কাজ করে থাকে। বিচার বিভাগ নিজ বিভাগের কর্মচারীদের নিয়োগ দান করেন। নাবালকের সম্পত্তি তত্ত্বাবধান ও দেখাশোনা করেন এবং তাদের অভিভাবক নিযুক্ত করেন। আইন ব্যবসায়ীদের লাইসেন্স প্রদান করে, দেউলিয়া প্রতিষ্ঠানের পক্ষে আদায়কারী ভূমিকা পালনের মত কাজগুলি বিচার বিভাগ করে থাকে।
৮। নাগরিকদের অধিকার সংরক্ষণ সংক্রান্ত কাজ: আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিচার বিভাগ নাগরিকদের অধিকার ও স্বাধীনতার রক্ষাকর্তা হিসেবে কাজ করে। যে দেশে লিখিত সংবিধান রয়েছে সেখানে আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগকে সংবিধানের গন্ডির মধ্যে থেকে কাজ করতে হয় সরকার যদি সংবিধানে লিপিবদ্ধ নাগরিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করে তাহলে বিচার বিভাগ সেই অধিকার পুন:প্রতিষ্ঠার কাজে অগ্রসর হয়।
পরিশেষে বলা যায় যে, বিচার বিভাগের ভূমিকা রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। বিচার বিভাগ দেশে ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে। বিচার বিভাগের নিরপেক্ষ ভূমিকার উপর নাগরিকের অধিকারের নিশ্চয়তা নির্ভর করে।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions