আইনসভার ক্ষমতা ও কার্যাবলী
আইনসভার ক্ষমতা ও কার্যাবলিকে প্রধানত দু'ভাগে ভাগ করা যায়। যথা- (ক) প্রত্যক্ষ কার্যাবলি ও (খ) পরোক্ষ কার্যাবলি।
(ক) প্রত্যক্ষ কার্যাবলি :
১। আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত : আইন প্রণয়ন করাই হল আইন বিভাগের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। দেশের সংবিধানের সাথে সঙ্গতি রক্ষা করে এবং জনমতের গতি-প্রকৃতির দিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে আইনসভা নতুন আইন প্রণয়ন করে। পুরাতন আইন সংশোধন এবং অপ্রয়োজনীয় আইন বাতিল করতে পারে। বর্তমানকালে আইনসভাই আইনের সর্বপ্রকার উৎস। আইনসভা কর্তৃক প্রণীত আইন দ্বারাই শাসন বিভাগ শাসন কার্য পরিচালনা করে এবং বিচারবিভাগ বিচারকার্য করে থাকে।
২। সংবিধান প্রণয়ন : সংশোধন সংক্রান্ত : আইনসভার একটি উল্লেখযোগ্য ক্ষমতা ও কাজ হচ্ছে দেশের মৌলিক আইন অর্থাৎ সংবিধান প্রবর্তন ও সংশোধন করা। কোন কোন রাষ্ট্রে আইন বিভাগ সংবিধানের চূড়ান্ত ব্যাখ্যাকর্তা হিসেবে কাজ করে। আবার কোন কোন দেশের আইনসভা সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্যে গণপরিষদের (Constituent Assembly) দায়িত্ব পালন করে। স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে যে সংবিধান প্রণীত হয়েছিল তা গণপরিষদ কর্তৃক প্রণীত হয়। পাশাপাশি আইনসভা সংবিধানের যে কোন ধারা বা অনুচ্ছেদ পরিবর্তন কিংবা সংশোধন করতে পারে।
৩। বিচার সংক্রান্ত : অনেক সময় আইন বিভাগ বিচার সংক্রান্ত কার্যাবলিও সম্পাদন করে। আইনসভা এর সদস্যদের আচার-আচরণের বিচার, আইনসভা কর্তৃক নির্বাচিত উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আনীত গুরুতর অভিযোগের বিচার, নির্বাচন সংক্রান্ত বিরোধের বিচার ইত্যাদি আইনসভার বিচার সংক্রান্ত কার্যাবলির অন্তর্গত। উদাহরণস্বরূপ, গুরুতর কোন অভিযোগ প্রমাণিত হলে, নির্দিষ্ট কার্যকাল শেষ হবার আগেই অভিশংসনের (Impeachment) মাধ্যমে মার্কিন রাষ্ট্রপতিকে অপসারিত করতে পারে সে দেশের আইনসভা। আবার ব্রিটেনে ২০০৯ সালে সুপ্রিম কোর্ট প্রতিষ্ঠিত হবার পূর্ব পর্যন্ত, শত-শত বছর ধরে পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ লর্ড সভা সে দেশের সর্বোচ্চ আপিল আদালত হিসেবে কাজ করে।
৪। শাসন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ : আইনসভার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল শাসন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করা। আইনসভার এরূপ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে শাসন বিভাগের স্বেচ্ছাচারিতা রোধ করা সম্ভব হয়। তবে শাসনব্যবস্থার প্রকৃতি অনুসারে বিভিন্ন দেশে এরূপ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে মাত্রাগত পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়।
৫। অর্থ-সংক্রান্ত : গণতন্ত্রে সরকারি অর্থ যেহেতু জনগণের তাই এ অর্থের যাতে অপচয় না হয় সেজন্য অর্থ সংক্রান্ত যাবতীয় ব্যাপারে গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা হয়। আইন বিভাগ বিগত বছরের সরকারি আয়-ব্যয়ের পর্যালোচনা, পরবর্তী বছরের জন্য ব্যয় বরাদ্দকরণের মত কাজের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে কার্যকর করে তোলে । আইনসভার অনুমতি ছাড়া নতুন কর (Tax) ধার্য কিংবা পুরাতন কর ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস করা যায় না।
৬ । শাসন সংক্রান্ত : আইনসভাকে শাসন সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজও সম্পাদন করতে হয়। সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় এমনকি রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থায়ও আইনসভা বিভিন্ন কমিটির মাধ্যমে শাসন সংক্রান্ত কার্যসম্পাদন করে। আইনসভা অনেক সময় উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী নিয়োগ দান করে। সন্ধি বা চুক্তি অনুমোদন করা, যুদ্ধ ঘোষণা করা প্রভৃতি আইনসভার শাসন সংক্রান্ত কার্য
৭। নির্বাচন সংক্রান্ত : আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আইনসভাকে নির্বাচন সংক্রান্ত কতকগুলো কাজ সম্পাদন করতে হয়। বাংলাদেশের আইনসভার সদস্যদের ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। সুইজারল্যান্ডের যুক্তরাষ্ট্রীয় আইনসভা যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিষদ (Federal Council)-এর সদস্যদের নির্বাচিত করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে কোনও প্রার্থী নির্বাচক সংস্থার (Electoral College) সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন লাভ করতে না পারলে, প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে প্রথম তিনজন প্রার্থীর মধ্যে যে কোন একজনকে প্রতিনিধি সভা (House of Representatives) রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করতে পারে। ভারতে রাষ্ট্রপতি ও উপ-রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে আইনসভা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৮। সংযোগসাধন সংক্রান্ত : দেশের বিভিন্ন এলাকার প্রতিনিধিরা নিজ-নিজ অঞ্চলের জনগণের অভাব-অভিযোগ ও সমস্যাবলি সম্পর্কে আইনসভায় আলোচনা করেন। এসব আলোচনার ভিত্তিতে সরকার প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
উপরোক্ত কার্যাবলি সম্পন্ন করা ছাড়াও, আইনসভা নানা ধরনের তদন্ত, বিচারকদের পদচ্যুতি, সরকারের গঠনমূলক সমালোচনাসহ নানাবিধ দায়িত্ব পালন করে।
(খ) পরোক্ষ কার্যাবলি
আইনসভার পরোক্ষ কার্যাবলিসমূহ নিম্নরূপ :
১। রাজনৈতিক বৈধকরণ : আইনসভা সব ধরনের সরকারের প্রণীত আদেশ, বিধিমালা বা নীতিসমূহকে বৈধতার ছাড়পত্র দিয়ে থাকে। এমনকি চরম কর্তৃত্ববাদী সর্বাত্মক শাসন ব্যবস্থায়ও আইনসভা সরকারের কার্যাবলি বৈধ করার একমাত্র মাধ্যম।
২। রাজনৈতিক অংশগ্রহণ : আইনসভার নির্বাচন সাধারণ জনগণকে রাজনৈতিক অংশগ্রহণের কাজে উদ্বুদ্ধকরণের প্রধানতম মাধ্যম। এ নির্বাচন নির্বাচকমন্ডলী ও প্রার্থীদের মধ্যে যোগাযোগের পথ তৈরি হয় এবং শাসনকার্যে জনগণের অংশগ্রহণে উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি করে।
৩। রাজনৈতিক মতৈক্য সৃষ্টি : আইনসভার বিতর্ক ও আলাপ-আলোচনা জাতীয় মতৈক্য সৃষ্টি এবং বিরোধ মীমাংসার ফলপ্রসূ মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। মতবিরোধের বিষয়গুলো নিয়ে আইনসভাতে খোলামেলা আলোচনার মধ্য দিয়ে পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটতে পারে।
৪। বিরোধ দূরীকরণ : আইনসভা রাজনৈতিক ব্যবস্থায় তীব্র মতাদর্শগত বিরোধ দূরীকরণে ব্যাপক মতৈক্য প্রতিষ্ঠা করতে পারলেও, জাতীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পারস্পরিক বিরোধ দূর করতে পারে।
৫। রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ সংক্রান্ত : গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আইনসভার সদস্যগণ বিভিন্ন বিষয়ে মতামত প্রদান করেন। অনেক সময় তারা ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে একই বিষয় নিয়ে আলোচনা, বিতর্ক ইত্যাদি করেন। সংবাদপত্র, বেতার, টেলিভিশন ইত্যাদির মাধ্যমে সেসব আলোচনা প্রচারিত হওয়ার ফলে জনগণের রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধি পায়। জনগণ সরকারি ক্রিয়াকলাপের উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখতে পারে।
সার্বিক বিবেচনা থেকে একথা বলা যায় যে, সরকারের তিনটি বিভাগের মধ্যে প্রত্যেকটিই অত্যন্ত প্রযোজনীয় হলেও, আইন বিভাগ এমন কতগুলো দায়িত্ব পালন করে যেগুলো গুরুত্বের বিচারে অন্য দুই বিভাগের তুলনায় এগিয়ে থাকে।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions