নেতৃত্ব কি
নেতৃত্বের ইংরেজি প্রতিশব্দ Leadership' শব্দটি ইংরেজি ‘Lead' থেকে এসেছে। Lead' শব্দের বাংলা অর্থ হল পরিচালনা করা, পথ দেখানো এবং নির্দেশ প্রদান করা। সুতরাং যিনি নির্দেশ প্রদান করেন, পথ দেখান এবং সামনে থেকে পরিচালনা করেন তাকে নেতা (Leader) বলে। আর নেতার গুণাবলিকে বা যোগ্যতাকে বলা হয় নেতৃত্ব।
সুতরাং ‘নেতৃত্ব' বলতে সাধারণত নেতার গুণাবলিকে বুঝায়। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানে নেতৃত্ব' শব্দটি এত সঙ্কীর্ণ অর্থে ব্যবহৃত হয় না। কোন ব্যক্তি বা কোন দলের নেতা কতখানি গুণের অধিকারী এবং তা অন্যদেরকে কতখানি প্রভাবিত করতে পারে, তার নিরীখেই নেতৃত্বের পরিমাপ হয়। নেতৃত্ব হচ্ছে একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক গুণ। সমাজ তথা রাষ্ট্রকে কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছে দেওয়াই নেতৃত্বের মূল লক্ষ্য। সুসংহত, পরিলক্ষিত কর্ম পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে নেতৃত্ব বিকাশ হয়। একজন ব্যক্তির কার্যনির্বাহ বা আদেশ-নির্দেশ প্রদান ও প্রয়োগের ক্ষমতাই নেতৃত্ব। সুযোগ্য নেতৃত্বের বদৌলতে কোন দেশ উন্নয়নের চরম শিখরে আরোহন করতে পারে ।
এইচ. ও ডানেল (H.0. Dunel) এর মতে, “সাধারণ লক্ষ্য অর্জনের জন্য জনগণকে সহযোগী হতে উদ্বুদ্ধ ও উদ্যোগী করার কাজকেই নেতৃত্ব বলে।”
ডব্লিউ গোল্ডনার (W. Gouldner) বলেন, “নেতৃত্ব ব্যক্তি বা দলের সেই নৈতিক গুণাবলি যা অন্যদের অনুপ্রেরণা দিয়ে বিশেষ দিকে ধাবিত করে”।
কিম্বল ইয়ং (Kimbal Young) এর মতে, “নেতৃত্ব হল ব্যক্তির সেই গুণাবলি যার মাধ্যমে সে অন্যের কর্মকান্ডকে প্রভাবিত করে এবং অন্যদের উপর প্রভাব বিস্তার করে।”
সুতরাং নেতৃত্ব হল একটি শক্তিশালী কৌশল বা প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে নেতা অন্যের উপর কর্তৃত্ব প্রয়োগ করতে পারে।
নেতৃত্বের প্রকারভেদ
নেতৃত্ব বিভিন্ন প্রকারের হতে পারে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও ব্যবস্থা বিশ্লেষণ করে কয়েক প্রকার নেতৃত্বের কার্যকারিতা তুলে ধরেছেন।
১। সম্মোহনী নেতৃত্ব : জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার সর্বপ্রথম সম্মোহনী নেতৃত্বের ধারণা দেন। কোন বিশেষ নেতা যখন তার বক্তব্য, চারিত্রিক দৃঢ়তা, সাহসিকতা, কর্মপদ্ধতি ও মোহনীয় ব্যক্তিত্বের প্রবল স্পর্শে রাষ্ট্রের নাগরিকদের তার প্রতি আনুগত্য প্রকাশে অনুপ্রাণিত ও উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হয় তখন সেই নেতৃত্বকে সম্মোহনী নেতৃত্ব বলে। জনগণ সম্মোহনী নেতৃত্বের কর্মকান্ডে আপুত, বিমুগ্ধ ও অন্ধ অনুকরণে অনুপ্রাণিত হয়। জনগণের বিশ্বাস অর্জন করে তাদের মনের মণিকোঠায় পৌঁছে যায় সম্মোহনী নেতৃত্ব। সম্মোহনী নেতৃত্বের অধিকারী ব্যক্তি সাধারণত রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সফলতা অর্জন করে দেশের সামগ্রিক কল্যাণে এমন কি স্বাধীনতা অর্জনে অদম্য ভূমিকা রাখেন। সম্মোহনী নেতৃত্বের অধিকারী হলেন ব্রিটিশ ভারতের মহাত্মা গান্ধী, বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ণ, দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা প্রমুখ।
২। বিশেষজ্ঞসুলভ নেতৃত্ব : যখন কোন ব্যক্তি বিশেষ জ্ঞান, উচ্চতর শিক্ষা ও দক্ষতার জন্য সুখ্যাতি অর্জন করে কোন সংঘ বা সংগঠনে অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দেন, তখন ঐ ব্যক্তির এরূপ গুণকে বিশেষজ্ঞসুলভ নেতৃত্ব বলে। কবি, সাহিত্যিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, বিজ্ঞানী, শিল্পী, অধ্যাপকদের মধ্যে থেকে বিশেষজ্ঞসুলভ নেতৃত্ব আসতে পারে।
৩। রাজনৈতিক নেতৃত্ব : রাজনৈতিক নেতৃত্ব কোন রাজনৈতিক আদর্শ ও কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে বিকাশ লাভ করে থাকে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে রাজনৈতিক আদর্শের ভিত্তিতে স্বাধীনতা আন্দোলনের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলকে সংগঠিত করার কাজে সাফল্য লাভ করে কোন ব্যক্তি রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধিকারী হয়ে উঠেন। ব্রিটিশ ভারতের মহাত্মা গান্ধী, অবিভক্ত বঙ্গে এ কে ফজলুল হক, বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ণ প্রমুখ ব্যক্তি রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
৪। প্রশাসনিক নেতৃত্ব : প্রশাসনের সাথে যে সকল ব্যক্তিবর্গ নিয়োজিত তাদের কোন প্রশাসনের বিশেষ যোগ্যতা, সাফল্য, দক্ষতা ও অন্যান্য গুণাবলির ফলে যে নেতৃত্ব গড়ে ওঠে তাকে প্রশাসনিক নেতৃত্ব বলে।
৫। গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব : যে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে জনগণের অথবা সংগঠনের সদস্যদের মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে যে নেতৃত্ব গড়ে ওঠে তাকে গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব বলে। একজন গণতান্ত্রিক নেতা গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়ে থাকেন এবং কর্মীদের মধ্যে দায়িত্ব ও ক্ষমতার কিছু অংশ বন্টন করেন।
৬। তত্ত্বাবধানকারী নেতৃত্ব : একনায়কতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় তত্ত্বাবধানকারী নেতৃত্ব লক্ষ্য করা যায়। একক শাসক হিসেবে নেতা সকল কার্য পরিচালনা করেন। সংগঠনের কাজে তার মতামতই প্রাধান্য পায়; জনগণের মতামত প্রকাশের কোন সুযোগ থাকে না।
৭। সমাজ সংস্কারক নেতৃত্ব : সমসাময়িক সামাজিক ব্যবস্থার কোন বিশেষ দিক সংস্কারের জন্য বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে অনুপ্রাণিত করা সমাজ সংস্কারকের অন্যতম প্রধান কাজ। যেমন, ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজা রামমোহন রায়, বেগম রোকেয়া, কাজী আব্দুল ওদুদ, সুফিয়া কামাল প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ সমাজ ও শিক্ষা সংস্কারক হিসেবে নন্দিত।
৮। প্রতীকধর্মী নেতৃত্ব : যে নেতা তার দেশ ও জাতির প্রকৃত ক্ষমতাশালী না হয়েও, মর্যাদার প্রতীক হিসেবে নেতৃত্ব দান করেন তাকে প্রতীকধর্মী নেতৃত্ব বলে। যেমন, ব্রিটেনের রাজা বা রাণী, থাইল্যান্ডের রাজা প্রমুখ।
৯। সর্বাত্মকবাদী নেতৃত্ব : সর্বাত্মকবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এ ধরণের নেতৃত্ব লক্ষ্য করা যায়। এ ধরণের নেতৃত্ব ব্যক্তির ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবন পর্যন্ত সবকিছু নেতা নিয়ন্ত্রণ করে। এ ধরনের রাষ্ট্রে সংবিধানের জায়গায় নেতার ইচ্ছাই সর্বোচ্চ আইন হয়ে উঠে।
১০। বুদ্ধিজীবী নেতৃত্ব ও চিন্তা : সৃজনশীল জগতে আলোড়ন ও প্রভাব সৃষ্টিকারী ব্যক্তি তার জ্ঞান, মেধা ও লেখনীর মাধ্যমে নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হন। যেমন, প্লেটো, কার্ল মার্কল, জা জ্যাক রুশো প্রমুখ।
পরিশেষে বলা যায়, নেতৃত্বের প্রকারভেদে ভিন্নতা লক্ষ্য করা গেলেও এর মূল লক্ষ্য সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণ সাধন করা।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions