সামাজিক গতিশীলতা কি
সামাজিক গতিশীলতা
আমরা যারা সমাজে বসবাস করি আমাদের প্রত্যেকেরই একেক ধরণের সামাজিক মর্যাদা রয়েছে। পরিবার। আমাদের প্রতি কী ধরণের মর্যাদা দিয়েছে কিংবা আমরা সমাজে কী ধরণের ভূমিকা পালন করি তার উপর ভিত্তি করে এই সামাজিক মর্যাদা তৈরি হয়। জন্মসূত্রে পরিবার আমাদেরকে যে ধরণের সামাজিক মর্যাদা প্রদান করে তাকে আরোপিত মর্যাদা বলা হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় কৃষকের ছেলে, জমিদারের নাতি। পরিবার সূত্রেই এ পদমর্যাদা তৈরি হয়েছে। পক্ষান্তরে আমরা আমাদের কর্মের মাধ্যমে নতুন যে মর্যাদা অর্জন করি তাকে বলা হয় অর্জিত মর্যাদা।
আমাদের সমাজ স্থবির নয়, বরং তা গতিশীল। এ গতিশীল সমাজের ঘটনা পরম্পরা ব্যক্তি জীবনকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে। ব্যক্তি জীবনেও তাই উত্থান-পতনের খেলা চলে। মানুষের সামাজিক পদমর্যাদাতেও আসে ব্যাপক পরিবর্তন। মানুষ সবসময় তার মর্যাদা বাড়াতে সচেষ্ট থাকে এবং তার বর্তমান পদমর্যাদা থেকে আরো উঁচু পদমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হতে চায়। যে প্রক্রিয়ায় ব্যক্তি বা গোষ্ঠী তার সাধারণ অবস্থা, সাধারণ মানের মর্যাদা, ক্ষমতা ও আর্থিক অবস্থা থেকে উন্নততর অবস্থা, উঁচু সামাজিক মর্যাদা, ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয় তাকে সামাজিক গতিশীলতা বলে। সহজ কথায় সামাজিক গতিশীলতা হলো সামাজিক পদমর্যাদার পরিবর্তন।
“সামাজিক গতিশীলতা হলো ব্যক্তি ও ব্যক্তিবর্গের একধরণের পদমর্যাদা থেকে অন্যধরণের পদমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হওয়া।” ("Social mobility is the movement of a person or person from one social status to another.") Wallace & Wallace, Sociology; P-275
সামাজিক গতিশীলতা বলতে বােঝায় “একজন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর এক ধরণের সামাজিক শ্রেণি বা স্তরে রূপান্তরিত হওয়া।” (Social mobility refers to the movement of an individual or group from one social class or stratum to another.") -W.P. Scott, Dictionary of Sociology, P-260
ব্যক্তি এবং গোষ্ঠী গতিশীলতা
সামাজিক গতিশীলতা ব্যক্তি বা গোষ্ঠী পর্যায়ের হতে পারে। এটা একদিকে যেমন ব্যক্তি পর্যায়ের হতে পারে, অন্যদিকে তেমনি পারিবারিক, গোষ্ঠীগত বা সমাজভিত্তিকও হতে পারে। ব্যক্তি পর্যায়ের গতিশীলতা হলো সেটাই যেখানে ব্যক্তির সামাজিক পদমর্যাদা নিম্নস্তর থেকে উঁচুস্তরে উন্নীত হয়। যেমন: একজন কৃষকের ছেলে ভালো পড়ালেখা করে ব্যাংকের ম্যানেজার হলো। এতে তার আর্থিক উন্নতির সাথে সাথে সামাজিক মর্যাদাও বাড়ল। জিমি কার্টার একজন বাদাম চাষী পরিবারের ছেলে, পরবর্তীকালে তিনি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হন। এ.পি.জে. আব্দুল কালাম দারিদ্রের চাপে ছোটবেলায় খবরের কাগজ বিক্রি করতেন, পরবর্তীকালে তিনি ভারতের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। এগুলো ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার মাধ্যমে নিজেদের পদমর্যাদা পরিবির্তন করা ।
ব্যক্তিগত গতিশীলতার মতোই যদি কোনো গোষ্ঠী একত্রে তাদের সামাজিক মান-মর্যাদা উন্নীত করতে সক্ষম হন তাহলে তাকে গোষ্ঠী গতিশীলতা বলা হয়ে থাকে। যেমন: আমেরিকায় ইহুদীরা একটা ছোট সম্প্রদায় হলেও ঐ সমাজে তারা উঁচু সামাজিক গতিশীলতার প্রকারভেদ রাশিয়ার বংশোদ্ভূত আমেরিকার সমাজবিজ্ঞানী পি.এ সরোকিন দু'ধরনের সামাজিক গতিশীলতার উল্লেখ করেছেন। যথা: (১) সমান্তরাল সামাজিক গতিশীলতা এবং (২) উলম্ব সামাজিক গতিশীলতা ।
১) সমান্তরাল সামাজিক গতিশীলতা:
যখন কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সামাজিক অবস্থান পরিবর্তন হয় কিন্তু মর্যাদা একইরকম থাকে, অর্থাৎ মর্যাদার তারতম্য ঘটে না। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে- রসায়ন শাস্ত্রের একজন বিশ্ববিদ্যালয় গ্রাজুয়েট শিক্ষা শেষে ক্যামিক্যাল কোম্পানীতে গবেষক হিসেবে নিয়োগ পেল। প্রায় এক বছর কাজ করার পর কোনো কারণে তার গবেষণা ভাল লাগলো না বলে সে কলেজে রসায়নের শিক্ষক হিসেবে যােগদান করলো। পেশাগত পরিবর্তনের ফলে তার সামাজিক অবস্থানে একটু পরিবর্তন এসেছে ঠিকই কিন্তু এতে তার সামাজিক মর্যাদার কোনো পরিবর্তন আসেনি। তার কারণ হলো এই দুই পেশাকে সমাজ প্রায় একই মর্যাদার বলে মনে করে। এটাই সমান্তরাল সামাজিক গতিশীলতা।
২) উলম্ব সামাজিক গতিশীলতা:
যখন কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সামাজিক পদমর্যাদা বর্তমান অবস্থা থেকে উন্নত বা
অবনত হয়। এখানে শ্রেণি, পেশা বা ক্ষমতা কাঠামোতে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মর্যাদার উত্থান পতন ঘটতে পারে। এটা ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর জীবন কালের যে কোনো পর্যায়ে ঘটতে পারে। উলম্ব সামাজিক গতিশীলতার অনেকগুলো ধরণ রয়েছে। এগুলো হল:
(ক) ঊর্ধ্বমুখী গতিশীলতা
(খ) নিম্নমুখী গতিশীলতা
(গ) আন্ত:প্রজন্ম গতিশীলতা।
(ঘ) অন্তস্থ প্রজন্ম গতিশীলতা এবং
(ঙ) কাঠামোগত গতিশীলতা
ক) ঊর্ধ্বমুখী গতিশীলতা: ঊর্ধ্বমুখী গতিশীলতা হলো সামাজিক পদমর্যাদার ক্রমোন্নতির নিরিখে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর নিম্ন সামাজিক পদমর্যাদা থেকে অপেক্ষাকৃত আরো উচ্চতর সামাজিক মর্যাদার অধিকারী হওয়া। অর্থাৎ যখন কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নিম্ন সামাজিক পদমর্যাদা থেকে উচ্চ সামাজিক পদমর্যাদার অধিকারী হয় তখন তাকে ঊর্ধ্বমুখী গতিশীলতা বলে। যেমন: রাজমিস্ত্রীর ছেলে উচ্চশিক্ষা শেষে যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন তাহলে তার পদমর্যাদা উন্নতর পদমর্যাদায় উন্নীত হয়। এটা উর্ধ্বমুখী গতিশীলতা।
খ) নিম্নমুখী গতিশীলতা: নিম্নমুখী গতিশীলতা হলো সামাজিক পদমর্যাদার ক্রমোন্নতির নিরিখে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর উচ্চ সামাজিক পদমর্যাদা থেকে অপেক্ষাকৃত আরো নিম্নতর সামাজিক মর্যাদার অধিকারী হওয়া। অর্থাৎ যখন কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী উচ্চ সামাজিক পদমর্যাদা থেকে নিম্ন সামাজিক পদমর্যাদার অধিকারী হয় তখন তাকে নিম্নমুখী গতিশীলতা বলে। যেমন: কোনো শীর্ষ কর্মকর্তা যদি দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হন ও দুর্নীতির দায়ে সাজা ভোগ করেন, তখন তার উচ্চ সামাজিক পদমর্যাদা ধুলিস্যাৎ হয়ে যায়। এটা নিম্নমুখী গতিশীলতা।
গ) আন্তঃপ্রজন্ম গতিশীলতা: সামাজিক গতিশীলতায় সময় অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার। একটি শিশু জন্মের পরপরই পরিবার তাকে যে মর্যাদা প্রদান করে, প্রাপ্ত বয়স্ক অবস্থায় সে হয়ত নতুন মর্যাদা অর্জন করে। নতুন পদমর্যাদা অর্জনের পর শিশুর পিতামাতার পদমর্যাদার সাথে অনেক পার্থক্য ঘটে। অর্থাৎ পদমর্যাদার নিরিখে যখন এক প্রজন্ম (বাবা-মা) অপেক্ষা পরবর্তী প্রজন্ম (সন্তান) এগিয়ে যায় তখন তাকে আন্ত:প্রজন্ম গতিশীলতা বলে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সামান্য। কাঠমিস্ত্রি পিতার সন্তান হয়ে বিল গেটস সমসাময়িক পৃথিবীর শীর্ষ ধনী হয়েছেন। এটি আন্ত:প্রজন্ম গতিশীলতা।
ঘ) অন্তস্থ প্রজন্ম গতিশীলতা: আন্ত:প্রজন্ম গতিশীলতায় কমপক্ষে দুই প্রজন্মের মধ্যকার পদমর্যাদায় তুলনা থাকে। পক্ষান্তরে, অন্তস্থ প্রজন্ম গতিশীলতায় শুধু একটি প্রজন্মের মধ্যকার পদমর্যাদার উত্থান-পতনের তুলনা থাকে। একজন ব্যক্তির সমগ্র জীবনকালের মধ্যে মর্যাদার উত্থান-পতনকে অন্তস্থ প্রজন্ম গতিশীলতা বলা হয়। জন্মসূত্রে সাধারণ। পদমর্যাদার অধিকারী হলেও বিল গেটসের উন্নতি ও সামাজিক পদমর্যাদা বেড়েছে ধাপে ধাপে। তাঁর জীবনকালের এই পদমর্যাদার ভিন্ন ভিন্ন পর্যায়কেই বলা হচ্ছে অন্তস্থ প্রজন্ম গতিশীলতা।
ঙ) কাঠামোগত গতিশীলতা: কাঠামোগত গতিশীলতা এমন এক ধরণের গতিশীলতা যা মূলত স্তরবিন্যাসের কাঠামো পরিবর্তনের ফলে সৃষ্টি হয়। এর ফলে নতুন কোনো গোষ্ঠী বা শ্রেণি অন্যদের থেকে বেশি গুরুত্ব পায়। সমাজে কাঠামোগত । পরিবর্তন হলে হঠাই নতুন কোনো গোষ্ঠী বা শ্রেণি বেশি গুরুত্ব পেতে শুরু করে। যেমন: যুদ্ধের পরিস্থিতিতে মিলিটারি। অফিসারদের কদর স্বাভাবিক অবস্থার থেকে অনেক বেড়ে যায়। কিছুদিন আগেও বিজ্ঞানী ও এ্যাডভোকেটরা সমাজের। চোখে অনেক উচু মর্যাদার অধিকারী ছিল। কিন্তু কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার ও প্রযুক্তিবিদরা অনেক উচু মর্যাদার জায়গাটা দখল করেছে, যেটা একসময় বিজ্ঞানী ও এ্যাডভোকেটরা দখল করেছিল। সমাজে কাঠামোগত পরিবর্তনের ফলেই এভাবে নতুন গোষ্ঠী বা শ্রেণি অন্যদের থেকে বেশি প্রাধান্য পায়। এটাই। কাঠামোগত গতিশীলতা।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions