কম্পিউটার আবিষ্কারের ইতিহাস
এই পর্যন্ত মানুষের উদ্ভাবিত সকল যন্ত্রের মধ্যে কম্পিউটার মানব সভ্যতাকে দিয়েছে এক নতুন মাত্রা। বিজ্ঞানের বিষ্ময়কর আবিষ্কার এই কম্পিউটারের জন্ম কিন্তু দু’এক দিনে হয়নি। এবং এই প্রযুক্তির বিকাশও দু’এক দিনে ঘটেনি, এর রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস। যিশুখ্রিস্টের জন্মের অনেক আগে থেকে শুরু করে বর্তমানকালের আধুনিক কম্পিউটার আবিষ্কারের মধ্যকার সময়ে গণন যন্ত্র হিসেবে বহু যন্ত্রের উদ্ভব হয়। সেইসব আদি গণনাকারী যন্ত্র সম্পর্কে ধারাবাহিক আলোচনা করা হলো:
অ্যাবাকাস (Abacus) :
গণনাকারী যন্ত্রের উন্মেষ ঘটে যিশুখ্রিস্টের জন্মের বহু বছর পূর্বে। খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০ অব্দে তৎকালীন চীন দেশে অ্যাবাকাস নামক একটি গণনাকারী যন্ত্র আবিষ্কৃত হয়। পৃথিবীর কোনো কোনো অঞ্চলে এখনও এই যন্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে। এই যন্ত্রটি ছিল দুই অংশবিশিষ্ট একটি আয়তকার ফ্রেম। উভয় অংশে একাধিক খাড়া তার আটকানো থাকে এবং প্রত্যেকটি তারের প্রথম অংশে ৫টি এবং দ্বিতীয় অংশে ২টি করে গুটি থাকে। প্রথম অংশের প্রতিটি গুটির মান ১ এবং দ্বিতীয় অংশের প্রতিটি গুটির মান ৫। এই গুটিসমূহকে দুই অংশে ৫টি এবং দ্বিতীয় অংশের প্রতিটি গুটির মান ৫। এই গুটিসমূহকে দুই অংশে বিভক্তকারী পার্টিশনের কাছাকাছি নিয়ে এসে গণনাকার্য সম্পন্ন করা হয়। চীন দেশে অ্যাবাকাসকে বলা হয় সুয়ানপান (Suapan) এবং জাপানে বলা হয় সরোবান (Soroban)।
নেপিয়ারের অস্থি (Napier's Bone) :
অ্যাবাকাসের সাহায্যে কেবল যোগ করা সম্ভব হতো। কিন্তু বিয়োগ, গুণ, ভাগ, প্রভৃতি করা সম্ভব হতো না। কাজেই আরও উন্নতমানের যন্ত্র আবিষ্কারের প্রচেষ্টা চলতে থাকে। ১৬১৪ সালে স্কটল্যান্ডের গণিতজ্ঞ জন নেপিয়ার (John Napier) গুণন কার্য সমাধা করার জন্য একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেন। জন নেপিয়ার হাড় দিয়ে এই যন্ত্র তৈরি করেছিলেন বলে এর নামকরণ করা হয় নেপিয়ারের অস্থি।
১০টি হাতির দাঁতকে নয় বগর্ে ভাগ করে প্রতিটি বর্গকে আবার কোনাকুনি দাগ দিয়ে প্রতিটির অংশে খোদাই করে সংখ্যা বসানো হয়। এই দশটি হাড় একত্রিত করলে কোনাকুনি দাগ মিলে লম্বা একটা দাগের সৃষ্টি করে। এতে ব্যবহৃত ১০টি দণ্ডের প্রত্যেকটিতে ১০টি সংখ্যা আছে। প্রথম দণ্ডের সংখ্যাগুলো হলো: ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭, ৮, ৯, ০। দ্বিতীয় দণ্ডের সংখ্যাগুলো প্রথম দণ্ডের দ্বিগুণ। অথ্যাৎ সংখ্যাগুলো হচ্ছে: ২, ৪, ৬, ৮, ১০, ১২, ১৪, ১৬, ১৮, ০। তৃতীয় দণ্ডে থাকে প্রথম দণ্ডের সংখ্যার তিনগুণ। এভাবে নয়টি দণ্ডে ক্রমানুসারে প্রথম দণ্ডে গৃহিত সংখ্যার নয়গুণ থাকে। দশক দণ্ডটিতে থাকে প্রথম দণ্ডের সংখ্যার ০ গুণ, অর্থাৎ কেবল শূণ্য।
পরবর্তী সময়ে কাঠের উপর খোদাই করে এ যন্ত্র তৈরি করা হয়। নেপিয়ারের এই যন্ত্র দিয়ে কেবল গুণ করা সম্ভব হতো। তবে এর মাধ্যমে দ্রুত কাজ করা যেতো না কারণ এটি ছিল সম্পূর্ণ হস্তচালিত।
স্লাইড রুল (Slide Rule) :
নেপিয়ারের অস্থির সাহায্যে গণনা পদ্ধতি ছিল বেশ জটিল। ১৬২০ সালে এডমান্ড গুন্টার (Edmund Gunter) স্লাইড রুল নামক একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেন। ১৬৩২ সালে ইংরেজ গণিতজ্ঞ উইলিয়াম অগ্ট্রেড (William Oughtred) এই স্লাইড রুলের ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করে। তিনি লগারিদম পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে একটি স্লাইডিং স্কেল তৈরি করেন। এই স্কেলের সাহায্যে যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ, বর্গমূল প্রভৃতি করা যেতো। এই স্কেলের দুটি অংশ, একটি চওড়া এবং অন্যটি সরু। চওড়া অংশে যে স্কেল থাকে তার মাঝে খাঁজ কেটে সরু স্কেল বসানো থাকে। ফলে সরু স্কেলটিকে সহজে বড় স্কেলের উপর সরানো যায়। বড় স্কেলে এবং ছোট স্কেলে যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ, বর্গমূল প্রভৃতি বের করার জন্য বিভিন্ন সংখ্যা খোদাই করা থাকে।
প্যাসকেলের ক্যালকুলেটর (Pascal's Calculating Machine) :
1642 খ্রিস্টাব্দে ব্লেইস প্যাসকেল (Blaise Pascal) নামক একজন ফরাসি যুবক প্রথম ক্যালকুলেটর যন্ত্র আবিষ্কার করেন। পিতার কাজে ঝামেলা কমানোর জন্য তিনি এটি আবিষ্কার করেছিলেন। তাঁর পিতা ছিলেন একজন শুল্ক কর্মকর্তা। বড় বড় সংখ্যার হিসেব কষতে তাঁর অসুবিধার হতো। পুত্র এই সমস্যার অবসান করার জন্য গিয়ার চালিত যন্ত্র আবিষ্কার করেন। এই যন্ত্র দিয়ে বড় বড় সংখ্যা সহজে যোগ করা যেতো।
এই যন্ত্র আবিষ্কারের ত্রিশ বছর পর অর্থাৎ ১৬৭৩ খ্রিস্টাব্দে গটফ্রিড ভন লাইবনিৎজ (Gottfried Wilhelm von Leibniz/Leibnitz) নামে একজন জার্মান গণিতবিদ প্যাসকেলের ক্যালকুলেটরের উন্নত সংস্করণ আবিষ্কার করেন। এই যন্ত্র দিয়ে যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ এবং বর্গমূল করা যেতো। কিন্তু কীভাবে এই যন্ত্রটি সঠিকভাবে তৈরি করতে হয় তা কেউ জানত না।
ব্লেইস প্যাসকেল এর সম্মানে একটি আধুনি প্রোগ্রামিং ভাষার নামকরণ করা হয়েছে 'Pascal'।
অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিন (Analytical Engine) :
পরিসংখ্যানবিদ হলেরিথের প্রচেষ্টার প্রায় পঞ্চাশ বছর পূর্বে চার্লস ব্যাবেজ (Charles Babbage : 26 December 1791 to 18 October 1871) নামে ইংল্যান্ডের ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গণিতের অধ্যাপক অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিন নামক একটি যন্ত্রের প্রস্তাব করেন। যা আধুনিক কম্পিউটারের মৌলিক রূপরেখা হিসেবে পরিচিত। এর আগে ১৮২২ সালে তিনি পূর্ববর্তী সকল গণকযন্ত্রের স্মৃতিভাণ্ডারের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। এই উপলব্ধি থেকেই তিনি অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিন নামক যন্ত্রের পরিকল্পনা করেন। তাঁর এই পরিকল্পনাকে তৎকালে ’ব্যাবেজের বোকামি’ বলে অভিহিত করা হতো। কিন্তু আধুনিক কম্পিউটার আবিষ্কারের ফলে সবাই অনুভব করছে যে, তাঁর এই পরিকল্পনা একশত বছর এগিয়ে ছিল। তিনি ভেবেছিলেন, স্মৃতিভাণ্ডারের তথ্য প্রবেশ করিয়ে দিলে গণকযন্ত্র পরবর্তী সময়ে সে তথ্যের উপর ভিত্তি করে একের পর এক অংকগুলো সমাধান করে ফেলতে পারবে। ব্যাবেজের পরিকল্পনা ছিল খুবই উন্নত। তবে প্রযুক্তিতে অনগ্রসরতার কারণে সে সময় তাঁর পরিকল্পনার বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। ১৮৭১ সালে ব্যাবেজ মৃত্যুবরণ করেন। তৎকালে ব্যাবেজকে বাতিকগ্রস্ত লোক মনে করা হলেও তাঁর ধারণা ও পরিকল্পনার জন্য তাঁকে আধুনিক কম্পিউটারের জনক বলে আখ্যায়িত করা হয়। তাঁর তৈরি অসংখ্য চিত্র ও নকশা কম্পিউটার বিকাশের জন্য প্রেরণার উৎস হয়ে আছে। উল্লেখ্য, চার্লস ব্যাবেজের সময় থেকে পাঞ্চড কাডর্ের ব্যবহার শুরু হয়।
চার্লস ব্যাবেজ ভেবেছিলেন, তাঁর পরিকল্পিত গণকযন্ত্রের হাতল ঘোরানোর পরিবর্তে যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ ইত্যাদি কাজের জন্য পাঞ্চড কার্ডের মাধ্যমে নির্দেশ দেয়া যাবে এবং পাঞ্চড কার্ডের ছিদ্রপথে তথ্য আদান-প্রদান করা যাবে। ইংরেজ কবি লর্ড বায়রনের (Lord Byron) কন্যা ডি অগাস্টা অ্যাডা লাভলেস (Lady Augusta Ada Lovelace) ছিলেন চার্লস ব্যাবেজের সহকর্মী, তিনি ছিলেন একজন মেধাবী গণিতবিদ। তিনি ব্যাবেজের কাজে কিছু ত্রুটি সংশোধন করেন এবং ব্যাবেজের পরিকল্পিত নকশার উপর একটি প্রোগ্রাম তৈরি করেন। এ প্রোগ্রাম তৈরি করার জন্য তাঁকে পৃথিবীর প্রথম প্রোগ্রামার হিসেবে অ্যাখ্যায়িত করা হয়। বিভিন্ন কারণে ব্যাবেজের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত না হলেও তাঁর পরিকল্পনার উপর ভিত্তি করে বর্তমান আধুনিক কম্পিউটার আবিষ্কৃত হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগ কর্তৃক উদ্ভাবিত 'Ada' নামক উচ্চস্তরের প্রোগ্রামিং এর ভাষাটি তাঁর সম্মানার্থে নামকরণ করা হয়েছে।
পাঞ্চড কার্ড (Punched Card) :
পাঞ্চড কার্ড আবিষ্কারের ইতিহাস ১৮০১ সালের দিকে। জোসেফ মেরি জ্যাকার্ড (Joseph Marie Jacquard) নামে একজন ফরাসি তাঁতি তাঁর যান্ত্রিক তাঁত নিয়ন্ত্রণের জন্য পাঞ্চড কার্ড আবিষ্কার করেছিলেন। কিন্তু ১৮৮০ সালের দিকে আদমশুমারিতে সমস্যা দেখা দেওয়ায় পাঞ্চড কার্ডকে উপাত্ত প্রক্রিয়াকরণের (Data-processing) মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্সাস ব্যুরো হারম্যান হলেরিথ (Herman Hollerith) নামের একজন পরিসংখ্যানবিদকে শুমারি সমস্যার সমাধানের জন্য দায়িত্ব প্রদান করে। হলেরিথ তাঁর মেশিন-পঠনযোগ্য (machine-readable) কার্ডের উন্নয়ন করেন এবং ‘সেন্সাস-মেশিন’ নামে একটি যন্ত্র তৈরির পরিকল্পনা করেন। হলেরিথের পদ্ধতিতে গণনায় পূর্বের চাইতে এক-অষ্টমাংশ সময় লাগত, ফলে ১৮৯০ সালের গণনায় তাঁর টেকনিকগুলো ব্যবহৃত হয়।
পাঞ্চড কার্ড ৮ সেন্টিমিটার চওড়া এবং ১০ সেন্টিমিটার লম্বা পাতলা শক্ত কাগজের তৈরি। কার্ডটি মেশিনে সঠিকভাবে স্থাপন করার জন্য এককোনা সামান্য কাটা থাকে। পাঞ্চড কার্ডের প্রক্রিয়া একটি সাধারণ ধারণার উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিলো। ধারণাটি হচ্ছে প্রদত্ত উপাত্ত প্রথমে ছিদ্রপথে সঙ্কেতরূপে (Coded form) কার্ডের রেকর্ড করা হতো। প্রক্রিয়াকরণের ধাপগুলো সম্পন্ন করার জন্য পরে এই কার্ডগুলো ইলেকট্রোমেকানিক্যাল মেশিনে ঢুকানো হতো। পাঞ্চড কার্ডের সাহায্যে উপাত্ত প্রক্রিয়াকরণ হস্তচালিত পদ্ধতির চাইতে অধিক দ্রুতগতিসম্পন্ন এবং নির্ভুল ছিল। তবুও এতে প্রতিটি ধাপের মধ্যে কার্ডের ট্রে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য মানুষের প্রয়োজন ছিল এবং এই কার্ড আলাদা আলাদা মেশিনে ঢোকাতে, চালনা করতে এব বন্ধ করতে হতো। উপাত্ত প্রক্রিয়াকরণে এই মনুষ্য হস্তপেক্ষ ছিল বড়ই ঝঞ্ঝাটপূর্ণ। কম্পিউটারে এই ঝঞ্ঝাট সন্দেহাতীতভাবে দূরীভূত হয়েছে। এখন আর প্রতিটি ধাপে মানুষের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয় না।
মার্ক-১ (Mark-1) :
চার্লস ব্যাবেজের অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিন তৈরির পরিকল্পনার পর থেকে কম্পিউটারের অগ্রগতি এক শতাব্দীর জন্য প্রায় স্তিমিত হয়ে পড়েছিলেনা। এর পর ১৯৩৭ সালে আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হাওয়ার্ড অ্যাইকেন Howard Aiken) ডিগ্রির কিছু ছাত্র এবং আইবিএম-এর কতিপয় প্রকৌশলীর সহায়তায় একটি প্রকল্প হাতে নিয়ে কম্পিউটারের উপর ব্যাপকভাবে গবেষণা শুরু করেন। তাঁর গৃহীত প্রকল্প সমাপ্ত হয় ১৯৪৪ সালে। এই প্রকল্পের ফলস্বরূপ হাওয়ার্ড অ্যাইকেন। বিশ্ববাসীকে উপহার দেন সর্বপ্রথম আবিষ্কৃত পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল কম্পিউটার মার্ক-১।
তখন মার্ক-১ এর আবিষ্কার ছিল এক বিষ্ময়কর ব্যাপার। এতে ইনপুট ও আউটপুটের মাধ্যম হিসেবে পাঞ্চড কার্ড এবং উপাত্ত সংরক্ষনের জন্য পেপার টেপ ব্যবহৃত হতো। এটি ২০ অংকের সংখ্যা গুণ করতে আনুমানিক ৫ সেকেন্ড সময় নিতো। মার্ক-১ কম্পিউটারটির ওজন ছিল ৫টন এবং আকৃতি ছিল বিশাল, এতে বিভিন্ন রকমের সাড়ে সাত লক্ষ যন্ত্রাংশের জন্য ৫০০ মাইল লম্বা তার ব্যবহার করা হয়েছিল। মার্ক-১ হচ্ছে একটি ইলেকট্রোমেকানিক্যাল কম্পিউটার। এটি ছিল কম্পিউটারের জনক নামে খ্যাত চার্লস ব্যাবেজের স্বপ্নের যথাযোগ্য মর্যাদার বাস্তবায়ন। ‘মধ্যযুগীয়’ এই যন্ত্রটি বর্তমানে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদর্শনের জন্য সংরক্ষিত আছে।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions