বাজার কাকে বলে
বাজারের সংজ্ঞা (Definition of Market)
সাধারণ অর্থে বাজার বলতে আমরা এমন একটি স্থানকে বুঝি যেখানে ক্রেতা-বিক্রেতার সমাগমে দ্রব্য সামগ্রী ক্রয় বিক্রয় হয়। কিন্তু অর্থনীতিতে এরূপ নির্দিষ্ট স্থানকে বাজার হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় না। অর্থনীতিতে বাজার বলতে একটি নিদিষ্ট দ্রব্য বা সেবা তার ক্রেতা ও বিক্রেতাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ দর কষাকষির মাধ্যমে নির্ধারিত দামে ক্রয় বিক্রয়কে বুঝায়। যেমন- পাটের বাজার, চায়ের বাজার, শেয়ার বাজার, স্বর্ণের বাজার ইত্যাদি। এক্ষেত্রে ক্রেতাবিক্রেতা একই স্থানে মিলিত হতে পারে কিংবা দূর থেকে টেলিফোন, ফ্যাক্স, পত্র বা দালাল মারফত লেনদেনের কাজ সম্পাদন করতে পারে।
ফরাশী অর্থনীতিবিদ ‘কূর্নো’-এর মতে অর্থনীতিবিদগণ বাজার শব্দ দ্বারা দ্রব্য সামগ্রী ক্রয়বিক্রয়ের নিদিষ্ট স্থানকে বুঝায় না, বরং যে কোন অঞ্চলের সমগ্রটিকে বুঝায়, যেখানে ক্রেতা ও বিক্রেতার অবিসংস্রবে দ্রব্যের মূল্য সহজে ও দ্রুততার মানে সমান হবার প্রবণতা দেখা দেয়।
‘চ্যাপম্যানের’ মতে ‘‘বাজার বলতে কোন নির্দিষ্ট স্থানকে বুঝায় না, বরং এক বা একাধিক দ্রব্যকে বুঝায় যা ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে প্রত্যক্ষ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নির্দিষ্ট দাম প্রতিষ্ঠিত হয়ে ক্রয়-বিক্রয় হয়’’।
সুতরাং বাজারের প্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্যগুলো হলো: (১) ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য একটি দ্রব্য বা সেবা; (২) দ্রব্যের ক্রেতা বা বিক্রেতা; (৩) দ্রব্যটি ক্রয় বিক্রয়ের এক বা একাধিক অঞ্চল; (৪) ক্রেতা বিক্রেতার মধ্যে দর কষাকষির মধ্যেমে দাম নির্ধারণ।
বাজারের আয়তন বা বিস্তৃতি (The Size or Extent of Market) : কোন কোন দ্রব্যের বাজারের আয়তন সংকীর্ণ। আবার কোন কোন দ্রব্যের বাজার বিস্তৃত। আয়তন বা বিস্তৃতির আলোকে বিবেচনা করলে কোন দ্রব্যের বাজার স্থানীয়, জাতীয় বা আন্তর্জাতিক হতে পারে।
যে সমস্ত বিষয়ের উপর বাজারের আয়তন বা বিস্তৃতি নির্ভর করে তা নিম্নে আলোচনা করা হলো:
১. দ্রব্যের চাহিদা : দ্রব্যের চাহিদা যত ব্যাপক সে দ্রব্যের বাজার তত বিস্তৃত, অন্যদিকে দ্রব্যের চাহিদা কম হলে তার বাজারও সংকীর্ণ হয়। যেমন- স্বর্ণের চাহিদা বিশ্বব্যাপী তাই তার বাজার বিশবজোড়া। মাছ, দুধ, শুটকী ইত্যাদির বাজার সংকীর্ণ।
২. দ্রব্যের যোগান : বাজারের বিস্তৃতি দ্রব্যের যোগানের উপরও নির্ভরশীল। ব্যাপক চাহিদার পাশাপাশি পর্যাপ্ত যোগান না থাকলে বাজার ব্যাপক হয় না।
৩. দ্রব্যের স্থায়িতব : যে সব দ্রব্য দীর্ঘস্থায়ী এবং টেকসই তাদের বাজার বিস্তৃত হয়। যেমন- সোনা, রূপা, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি দীর্ঘস্থায়ী বলে এদের বাজার বিস্তৃত। যেমন - ক্ষণস্থায়ী ও পঁচনশীল দ্রব্যের বাজার অল্প সময়ের মধ্যেই ভোগ করে ফেলতে হয়, যেমন - দুধ, মাছ, সব্জির ইত্যাদির বাজার ছোট।
৪. পরিবহনযোগ্যতা : যে সব দ্রব্য হালকা অথচ দামী সেগুলি অতি সহজেই এবং অল্প খরচে স্থানান্তর করা যায়। তাই এদের বাজার বিস্তৃত, সোনা, রূপা ইত্যাদি মূল্যবান এবং স্থানান্তর খরচ কম। তাই এদের বাজার ব্যাপক। সেসব দ্রব্য ভারী এবং স্থানান্তর কষ্টসাধ্য ও ব্যয়বহুল যেসব দ্রব্যের বাজার সীমিত। যেমন- ইটের বাজার।
৫. শ্রেণী বিভাগ ও নমুনাকরণ : যেসব দ্রব্যের গুণাগুন অনুযায়ী শ্রেণীভেদ ও নমুনাকরণ করা যায় সেসব দ্রব্যের বাজার ব্যাপক।
৬. যাতায়ত ও পরিবহন ব্যবস্থা : যাতায়ত ও পরিবহন ব্যবস্থা উন্নত হলে দ্রব্যাদি সহজে এবং সময়মত দূরে পাঠানো সম্ভব হয় বলে বাজার বিস্তৃত হয়।
৭. শান্তি ও নিরাপত্তা : দেশের ভিতরে ও বাইরে শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় থাকলে নির্বিঘ্নে দ্রব্যসামগ্রী স্থানান্তর করা যায়। ফলে বাজার বিস্তৃত হয়।
৮. বাণিজ্যনীতি : সরকারের বাণিজ্য নীতি সহজ ও উদার হলে বাজার বিস্তৃত হয়।
৯. আর্থিক নীতি : সরকারের আর্থিক নীতি সহজ হলে (যেমন- সহজ শর্তে ঋণ প্রাপ্তি, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার স্থিতিশীল) বাজার বিস্তৃত হয়।
১০. প্রচার : বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে দ্রব্যের দাম, গুণাগুণ, প্রাপ্তি স্থান ইত্যাদি সম্পর্কে ক্রেতাদের বেশি তথ্য দেয়ার সুযোগ থাকলে বাজার বিস্তৃত হয়।
১১. শ্রম বিভাগের মাত্রা : উৎপাদন প্রক্রিয়ায় অধিকমাত্রায় শ্রম বিভাগের প্রয়োগ হলে কম খরচে বেশি উৎপাদন সম্ভব। ফলে বাজার বিস্তৃত হয়।
বাজারের শ্রেণীবিভাগ (Classification of Market)
আয়তন, সময় এবং প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে বাজারকে নিম্নোক্তভাবে শ্রেণীভেদ করা যায়-
১. পরিধি অনুসারে : স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাজার।
ক. স্থানীয় বাজার (Local Market): যে দ্রব্যের বাজার দেশের একটি বিশেষ স্থান বা অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে তার বাজারকে স্থানীয় বাজার বলে, যেমন- মাছ, দুধ, শাক-সবজির বাজার।
খ. জাতীয় বাজার (National Market): কোন দ্রব্যের বাজার সারা দেশ ব্যাপী হলে তাকে জাতীয় বাজার বলে, যেমন- দেশীয় বস্ত্র, প্রসাধনী ইত্যাদির বাজার।
গ. আন্তর্জাতিক বাজার (International Market) : কোন দ্রব্যের বাজার দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে অন্যান্য দেশেও সম্প্রসারিত হলে সে বাজারকে আন্তর্জাতিক বাজার বলা হয়। যেমন- সোনা, রূপা, উন্নতমানের তৈরী পোষাক, যন্ত্রপাতির বাজার।
২. সময়ের ভিত্তিতে : অতি স্বল্পকালীন, স্বল্পকালীন ও দীর্ঘকালীন বাজার।
ক. অতিস্বল্পকালীন বাজার (Very Short Period Market) : যখন কোন দ্রব্যের ক্রয়বিক্রয় অতি অল্প সময়ের মধ্যে সম্পন্ন হয় তখন সে বাজারকে অতি স্বল্পকালীন বাজার বলে। এ ধরনের বাজারে দ্রব্যের যোগান অপরিবর্তনীয়, তাই দ্রব্যের দাম নির্ধারণে তার চাহিদার ভূমিকাই মুখ্য। মাছ, শাক-সবজি ইত্যাদির বাজার এর আওতাভূক্ত।
খ. স্বল্পকালীন বাজার (Short Period Market) : যে বাজারে পরিবর্তিত চাহিদার সাথে দ্রব্যের যোগানের সামান্যতম সমন্বয় সাধন সম্ভব তবে তা কেবলমাত্র পরিবর্তনশীল উপকরণে (কাঁচামাল, শ্রম) পরিবর্তনের মাধ্যমে সম্ভব, স্বল্পকালে উৎপাদন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা, আয়তন, যন্ত্রপাতির পরিমাণ এর কোনরূপ পরিবর্তন করা যায় না। এ ধরনের বাজারে দ্রব্য মূল্য নির্ধারণে যোগানের তুলনায় চাহিদার ভূমিকা অধিক।
গ. দীর্ঘকালীন বাজার (Long Period Market) : যে বাজারে পরিবর্তিত চাহিদার মাঝে যোগানের সম্পূর্ণরূপে সমন্বয় সাধন সম্ভব। দীর্ঘকালীন সময়ে উৎপাদন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা, আয়তন, যন্ত্রপাতি, উৎপাদন পদ্ধতির পরিবর্তন করে দ্রব্যের যোগান এবং চাহিদার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা যায়। এ দীর্ঘকালে উৎপাদনের সকল উপাদানই পরিবর্তনশীল, চাহিদা ও যোগানের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে দীর্ঘকালীন দাম নির্ধারিত হয়।
৩. প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে : পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজার ও অপূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজার।
ক. পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজার (Perfect Competition) : যে বাজারে অসংখ্য ক্রেতা ও বিক্রেতা একটি সমজাতীয় দ্রব্য দর কষাকষির মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট দামে তা ক্রয় বিক্রয় করে তাকে পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজার বলে।
খ. অপূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজার (Imperfect Competition) : যে বাজারে অনেক ক্রেতা থাকবেও বিক্রেতার সংখ্যা কম এবং দ্রব্যের দামের উপর বিক্রেতার প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয় তাকে অপূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজার বলে। অপূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজার নানা ধরনের। যেমন- একচেটিয়া বাজার, একচেটিয়া মূলক প্রতিযোগিতার বাজার, অলিগোপলি বাজার, ডুয়োপলি বাজার, মনোপসনি বাজার, বাইলেটারেল মনেরপলি বাজার।
i. একচেটিয়া বাজার (Monopoly Market) : যে বাজারে দ্রব্যের একজন মাত্র বিক্রেতা এবং দ্রব্যের দামের উপর তার আধিপত্য বিদ্যমান, তাকে একচেটিয়া বাজার বলে। দ্রব্যটির কোন নিকট বিকল্প নেই এবং বাজারে অন্য কোন উৎপাদনকারীর প্রবেশাধিকার নেই। একচেটিয়া কারবারী তার দ্রব্যের জন্য বিভিন্ন বাজার থেকে বিভিন্ন দাম আদায় করতে পারে। এ ধরনের বাজারকে বলে দাম বিভেদমূলক একচেটিয়া বাজার।
ii. একচেটিয়া প্রতিযোগিতামূলক বাজার (Monopolistic Competition) : যে বাজারে একচেটিয়া ও প্রতিযোগিতামূলক বাজারের বৈশিষ্ট্য একই সংগে বিদ্যমান থাকে তাকে একচেটিয়া প্রতিযোগিতামূলক বাজার বলে। এ বাজারে বিক্রেতার সংখ্যা অনেক তবে অসংখ্য নয়। এরূপ বাজারে দ্রব্যগুলি সমজাতীয় নয় তবে এরা পরস্পরের নিকট বিকল্প ট্রেডমার্ক, মোড়ক, রং ইত্যাদির সামান্য পরিবর্তনের মাধ্যমে ক্রেতাদের নিকট একটি দ্রব্য অন্যটি থেকে পৃথক করা হয়। যেমন- বিভিন্ন রকম টুথপেষ্ট, টয়লেট সাবান।
iii. অলিগোপলি বাজার (Oligopoly) : যে বাজারে বিক্রেতা দু’য়ের অধিক কিন্তু খুব বেশি নয় তাকে অলিগোপলি বাজার বলে। একজনের দাম উৎপাদন নীতি অন্যরা সতর্কতার সাথে পর্যবেক্ষণ করে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
iv. ডুয়োপলি বাজার (Duopoly) : যে বাজারে বিক্রেতা মাত্র দু’জন কিন্তু ক্রেতা অসংখ্য তাকে ডুয়োপলি বাজার বলে।
v. মনোপসনি বাজার (Monopsony): যে বাজারে বিক্রেতা অসংখ্য কিন্তু ক্রেতা মাত্র একজন তাকে মনোপসনি বাজার বলে।
vi. বাইলেটারেল মনোপলি বাজার (Bilateral Monopoly): যে বাজারে ক্রেতা ও বিক্রেতা মাত্র একজন করে সে বাজারকে বাইলেটারেল মনোপলি বাজার বলে।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions