মূলধন কাকে বলে
পুঁজি বা মূলধন কি: সাধারণ অর্থে, পুঁজি বা মূলধন বলতে ব্যবসায়ে নিয়োজিত টাকা পয়সাকে বুঝায়। কিন্তু অর্থনীতিতে মূলধন শব্দটি বিশেষ অর্থ জ্ঞাপন করে। মানুষের শ্রমের দ্বারা উৎপাদিত দ্রব্য সামগ্রীর যে অংশ সরাসরি ভোগের জন্য ব্যয়িত না হয়ে পুনরায় উৎপাদন কাজে ব্যবহৃত হয় এবং নতুন আয় প্রবাহ সৃষ্টি করে তাকে মূলধন বলে। মূলধন মানব সৃষ্ট, প্রকৃতি প্রদত্ত নয়। যেমন, বঙ্গবন্ধু বহুমুখী যমুনা সেতু, রেল লাইন, কারখানা, কাঁচামাল, কৃষকের লাঙ্গল, অফিস, গুদাম, ওয়ারলেস সেট ইত্যাদি মূলধন। অর্থনীতিবিদ বম ওয়ার্কের ভাষায়, মূলধন উৎপাদনের উৎপাদিত উপাদান। (Capital is the produced means of production)। অর্থনীতিবিদ চ্যাপম্যান বলেন, ‘‘যে সম্পদ কোন আয় সৃষ্টি করে অথবা উপার্জনে সহায়তা করে তা-ই হল মূলধন। (Capital is wealth which yields an income or aids in the production of an income)। কোন দ্রব্য মূলধন হিসেবে গণ্য হবে কিনা তা ঐ দ্রব্যের ব্যবহারের উপর নির্ভর করে। বাড়ী-ঘর যখন বাসস্থান হিসেবে ব্যবহৃত হয় তখন এটা মূলধন নয়। কিন্তু ঐ বাড়ী-ঘর যদি অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হয় তখন এটা মূলধন। সুতরাং যে সব দ্রব্য সামগ্রী মানুষের শ্রম দ্বারা উৎপাদিত এবং যা বর্তমান ভোগের জন্য ব্যবহৃত না হয়ে অধিক উৎপাদন কাজে ব্যবহৃত হয় তাকেই অর্থনীতিতে পুঁজি বা মূলধন বলা হয়।
মূলধনের বৈশিষ্ট্য
মূলধন হল উৎপাদনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। নিম্নে বর্ণিত বৈশিষ্ট্যসমূহের জন্য মূলধনকে অন্যান্য উপাদান থেকে পৃথক বলে গণ্য করা হয়। যথা :
১. মূলধন উৎপাদনশীল : আধুনিক উৎপাদন ব্যবস্থা মূলধনের উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। পুঁজি উৎপাদন ক্ষেত্রে মূলধনের গুরুত্ব আরো অধিক। যেমন, খালি হাতের চেয়ে জাল দিয়ে অধিক পরিমাণ মাছ ধরা যায়। অত্যাধুনিক জালের সাহায্যে আরো অধিক পরিমাণ মাছ ধরা হয়। সুতরাং পুঁজি নতুন পণ্য ও সেবা উৎপাদন করতে সাহায্য করে।
২. মূলধন উৎপাদনের উৎপাদিত উপাদান : মূলধনের অপর বৈশিষ্ট্য হল যে, এটি উৎপাদনের উৎপাদিত উপাদান। ভূমি বা শ্রমের ন্যায় মূলধন কোন মৌলিক উৎপাদন নয়। মানুষের শ্রম ও প্রাকৃতিক সম্পদের যৌথ প্রচেষ্টায় মূলধন সৃষ্টি হয় যা মানুষ সরাসরি ভোগ না করে ভবিষ্যৎ উৎপাদন কার্যে ব্যবহার করে।
৩. মূলধন অতীত শ্রমের ফল : মূলধন মানুষের অতীত শ্রমের পুঞ্জিভুত ফল। যন্ত্রপাতি, কলকারখানা, কাঁচামাল প্রভৃতি দ্রব্যাদি যা মূলধন হিসেবে গণ্য হয় তা মানুষের পরিশ্রমের দ্বারা সৃষ্টি। জমির মতো এটি প্রাকৃতিক উপাদান নয়।
৪. মূলধন সঞ্চয়ের ফল : মূলধন হল সঞ্চয়ের ফল। মূলধন বৃদ্ধির জন্য সঞ্চয়ের প্রয়োজন হয়। মূলধন গঠন করতে হলে বর্তমান আয় বা উৎপাদনের একটি অংশ ভোগে না লাগিয়ে উৎপাদন কাজে ব্যবহার করা হয়। তাই মূলধন সৃষ্টি করতে মানুষকে তার আয়ের একাংশ বর্তমান ভোগে ব্যবহার না করে ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করতে হবে।
৫. মূলধন অস্থায়ী : মূলধন স্থায়ী সম্পদ নয়-এর ক্ষয়ক্ষতি আছে। যন্ত্রপাতি বা ঘরবাড়ীর আয়ুষ্কাল নির্দিষ্ট। দীর্ঘ ব্যবহারের ফলে মূলধন দ্রব্যসামগ্রী ক্ষয় প্রাপ্ত হয় এবং অকেজো হয়ে পড়ে। ফলে এর পরিবর্তন প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ায়।
৬. মূলধনের উৎপাদন খরচ আছে : মূলধন মানুষ দ্বারা উৎপাদিত। মূলধন প্রাকৃতিক সম্পদ নয়। তাই মূলধনের উৎপাদন খরচ আছে।
৭. মূলধন সমজাতীয় নয় : সকল মূলধন একই গুণসম্পন্ন নয়। বিভিন্ন মূলধনের গুণগত পার্থক্য আছে এটি স্বতন্ত্র ক্রিয়াসম্পন্ন বিবিধ বস্ত্তর একটি জটিল সমষ্টি।
৮. মূলধন আয়ের উৎস : মূলধন ব্যবহারের প্রধান উদ্দেশ্য হল ভবিষ্যৎ আয়ের পথ সৃষ্টি করা। মূলধন ব্যবহার করলে উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় এবং অতিরিক্ত আয় সৃষ্টি হয়। এজন্য অধ্যাপক মার্শাল মূলধনকে আয়ের উৎস হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
মূলধনের শ্রেণীবিভাগ
বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে মূলধনকে নানাভাবে ভাগ করা যায়। নিম্নে এসব শ্রেণীবিভাগ আলোচনা করা হল :
১. ব্যক্তিগত মূলধন ও জাতীয় মূলধন : মালিকানার ভিত্তিতে মূলধনকে দু‘ভাগে ভাগ করা হয়: যথা - (ক) জাতীয় মূলধন এবং (খ) ব্যক্তিগত মূলধন। যে সকল মূলধন কোন ব্যক্তি বিশেষের মালিকানায় থাকে তাকে ব্যক্তিগত মূলধন বলা হয়। যেমন - ব্যক্তির মালিকানাধীন কল্লকারখানা, ঘর-বাড়ী, শেয়ার ইত্যাদি। যে মূলধনে সমষ্টিগত মালিকানা থাকে অর্থাৎ রাষ্ট্রের অধীনে যে সকল মূলধন থাকে তাকে জাতীয় মূলধন বলা হয়। জাতীয় মূলধন সরকারী মূলধন ও ব্যক্তিগত মূলধন উভয়কে নিয়েই গঠিত হয়। অর্থাৎ একটি দেশের সরকারী ও বেসরকারী মূলধন মিলিয়েই জাতীয় মূলধন গড়ে উঠে। যেমন, রাষ্ট্রায়ত্ত বা রাষ্ট্র মালিকানাধীন কলকারখানা, ব্যাংক, রেলওয়ে, বিমান এবং ব্যক্তিগত মালিকানাধীন সকল প্রকার কলকারখানা যন্ত্রপাতি ইত্যাদি সব কিছুই জাতীয় মূলধনের অন্তর্গত।
২. ভোগ্য মূলধন ও উৎপাদক মূলধন : ব্যবহারের ভিত্তিতে মূলধনকে দু‘ভাগে ভাগ করা যায়; যথা (ক) ভোগ্য মূলধন এবং (খ) উৎপাদন মূলধন। উৎপাদন চলাকালে উৎপাদন কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের ভরণ পোষণ ও জীবন যাত্রা নির্বাহের জন্য যে মূলধন ব্যবহৃত হয় তাকে ভোগ্য মূলধন বলে। যেমন - শ্রমিকদের খাদ্য, বাসস্থান, বস্ত্র ইত্যাদি। অপরপক্ষে, যে সকল মূলধন উৎপাদনে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করে তাকে উৎপাদক মূলধন বলে। যেমন, কলকারখানা, যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল ইত্যাদি।
৩. স্থায়ী মূলধন ও চলতি মূলধন : স্থায়িত্বের ভিত্তিতে মূলধনকে দু’ভাগে ভাগ করা যায় - যথা (ক) স্থায়ী মূলধন ও (খ) চলতি মূলধন। যে মূলধন উৎপাদন কাজে একবার ব্যবহারেই শেষ হয়ে যায় না; বরং তা বহুদিন ধরে বারবার ব্যবহৃত হয় তাকে স্থায়ী মূলধন বলে। যেমন - কলকারখানা, যন্ত্রপাতি, বাড়ীঘর, গুদাম প্রভৃতি স্থায়ী মূলধনের অন্তর্ভুক্ত। পক্ষান্তরে, যে মূলধন মাত্র একবার ব্যবহারেই নিঃশেষ হয়ে যায় তাকে চলতি
মূলধন বলে। যেমন, তুলা, পাট, কাঠ, কয়লা প্রভৃতি। এ সকল দ্রব্য একবার ব্যবহারের ফলেই এদের আকৃতির পরিবর্তন ঘটে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, কয়লা একবার পুড়ালে ছাই হয়ে যায় - এর অস্তিত্ব থাকে না। তুলা থেকে সুতা প্রস্ত্তত করলে তুলার আকৃতিতে পরিবর্তন ঘটে। সুতরাং যে সকল মূলধন মাত্র একবার ব্যবহারের ফলেই শেষ হয়ে যায় তাকে চলতি মূলধন বলে।
৪. নিমজ্জমান মূলধন ও ভাসমান মূলধন : ব্যবহরের ভিত্তিতে মূলধনকে দু‘ভাগে ভাগ করা যায়; যথা - (ক) নিমজ্জমান মূলধন ও (খ) ভাসমান মূলধন। যে সব মূলধন মাত্র একটি বিশেষ ধরনের উৎপাদন কাজে ব্যবহৃত হয় এবং যা অন্য কাজে ব্যবহার করা যায় না তাকে নিমজ্জমান বা আবদ্ধ মূলধন বলে। যেমন- রেল ইঞ্জিন, লোহা গলাবার চুল্লী ইত্যাদি। পক্ষান্তরে, যে সব মূলধন বিভিন্ন উৎপাদন কাজে ব্যবহার করা হয় বা এক শিল্প থেকে অন্য শিল্পে স্থানান্তর করা যায় তাকে ভাসমান মূলধন বলে। যেমন - কয়লা, বিদ্যুৎ, কাঁচামাল, ইঞ্জিন ইত্যাদি।
মূলধনের গুরুত্ব ও কার্যাবলী
আধুনিক উৎপাদন ব্যবস্থায় মূলধন হ‘ল একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। মূলধন ছাড়া কোন কিছু উৎপাদন করা সম্ভব নয়। শিল্প বিপ-বের আগে মূলধনের গুরুত্ব এতটা ছিল না। কিন্তু শিল্প বিপ-বের পর হতেই উৎপাদন ক্ষেত্রে মূলধনের গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। সব উপাদান উৎপাদনশীল হলেও মূলধনের উৎপাদনশীলতা সর্বাধিক। বস্ত্ততঃ আধুনিক উৎপাদন ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে মূলধন নির্ভর। মূলধনের প্রাচুর্যই পশ্চিমের দেশসমূহের উন্নত দেশরূপে গণ্য হবার কারণ। তাই মূলধনের প্রাচুর্য উন্নয়নের চাবিকাঠি। আমেরিকা, বৃটেন, জাপান, জার্মান, চীন, রাশিয়া প্রভৃতি দেশের উন্নয়নের পশ্চাতে প্রধান অবদান রয়েছে মূলধনের প্রাচুর্য।
নিম্নে মূলধনের কার্যাবলী আলোচনা করা হল :
১. মূলধন উৎপাদন বৃদ্ধি করে : মূলধন উৎপাদন বৃদ্ধির প্রধান সহায়ক। মূলধন ব্যবহারের ফলে প্রত্যেকটি উৎপাদনের উপাদানের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। শ্রমিক যখন আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে তখন পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি ও উন্নতমানের দ্রব্যাদি উৎপাদন করতে সক্ষম হয়। তাই মূলধন ব্যবহারের ফলে দ্রব্যের পরিমাণ শুধু বৃদ্ধি পায় না, সেই সঙ্গে উৎকৃষ্টমানের দ্রব্যও উৎপাদিত হয়। ফলে সার্বিকভাবে জাতীয় আয় বৃদ্ধি পায়।
২. শ্রমিকের দক্ষতা বৃদ্ধি করে : মূলধন শ্রমিকের দক্ষতা বৃদ্ধি করে। উন্নত যন্ত্রপাতি ব্যবহারের মাধ্যমে শ্রমিকদের কর্ম দক্ষতা বৃদ্ধি পায় এবং তারা অল্প সময়ে অধিক পরিমাণ দ্রব্য উৎপাদন করতে পারে। মূলধন শ্রমিকদের দৈহিক শ্রম লাঘব করে। ভারী ও কঠিন কাজ যা শ্রমিকদের দৈহিক শক্তির উপর চাপ প্রদান করতো তা এখন যন্ত্রের সাহায্যে অনায়াসে সম্পন্ন করা যায়।
৩. মূলধন যন্ত্রপাতি যোগান দেয় : মূলধন বৃদ্ধির মাধ্যমে কারখানায় উন্নতমানের যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করতে সাহায্য করে। আধুনিক যন্ত্রপাতি ক্রয়ের জন্য মোটা অংকের অর্থের প্রয়োজন হয়। মূলধন এই অর্থ যোগান দিয়ে তা সম্ভব করে।
৪. মূলধন কাঁচামাল যোগান দেয় : মূলধন শিল্পের জন্য কাঁচামাল সংগ্রহ করতে সাহায্য করে। কোন শিল্পজাত দ্রব্য উৎপাদন করতে কাঁচামাল প্রয়োজন। এই কাঁচামাল যোগান দিতে মূলধন অপরিহার্য। অতএব, কাঁচামাল সরবরাহ করা মূলধনের অন্যতম কাজ।
৫. মূলধন বৃহদায়তন উৎপাদনে সহায়তা দেয় : মূলধন ব্যবহারের ফলেই বৃহদায়তন উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। মূলধন ব্যতীত বৃহদায়তন শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠা করা
অসম্ভব। মূলধনের সাহায্যেই উন্নত ধরনের যন্ত্রপাতি ব্যবহার এবং শ্রম বিভাগের সুবিধা লাভ সম্ভবপর হয়েছে। এর ফলে স্বল্প ব্যয়ে উৎপাদন সম্ভব হয়েছে।
৬. মূলধন উৎপাদন ও ভোগের মধ্যে সমন্বয় ঘটায় : মূলধন ব্যবহারের দ্বারা উৎপাদন ও শ্রমের মধ্যে সমন্বয় ঘটে। পূর্বে শ্রমিক কোন দ্রব্য উৎপাদন করে বিক্রয় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো। কিন্তু শ্রম বিভাগ প্রবর্তনের পর কোন শ্রমিকের কাজ শেষ হবার পরপরই তার দৈনন্দিন ভরণ পোষণের জন্য পারিশ্রমিক পরিশোধ করা হয় এবং আর্থিক মূলধন থেকেই তা সম্ভব হয়। তাছাড়া মূলধন একটি দ্রব্য উৎপাদনের কাজ আরম্ভ এবং তা সম্পন্নের জন্য প্রয়োজনীয় সময়ের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করে-ধারাবাহিকতা বজায় রাখে।
৭. মূলধন সময় সংক্ষেপ করে : মূলধন ব্যবহারের ফলে সময় সংক্ষেপ করা সম্ভবপর হয়েছে। শ্রম বিভাগের ফলে প্রত্যেকটি শ্রমিককে যেহেতু একটি নির্দিষ্ট কাজ সম্পন্ন করতে হয় তাই প্রত্যেকটি স্তরের কাজ স্বল্প সময়েই সম্পন্ন করা সম্ভব হয় এবং সময়ের অপচয় রোধ করা যায়।
৮. মূলধন কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করে : মূলধনের সাহায্যে দ্রুত শিল্পায়ন সম্ভব হয়েছে। মূলধনের পরিমাণ বৃদ্ধির সাথে সাথে বিনিয়োগের পরিমাণ বেড়ে যায়। এর ফলে নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি পায়। বিকাশমান দেশগুলোতে বেকার সমস্যার অন্যতম প্রধান কারণ মূলধনের অভাব। মূলধনের যোগান বৃদ্ধি করতে পারলে এসব দেশের প্রাকৃতিক সম্পদসমূহ কাজে লাগিয়ে উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত করা যাবে।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions