মূলধন গঠন বলতে কী বোঝায়
মূলধন গঠন কাকে বলে : অর্থনীতিতে মূলধন গঠন বলতে মূলধন বৃদ্ধির প্রক্রিয়াকে বুঝায়। কোন দেশ একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তার মূলধন সম্পদ বা পুঁজিদ্রব্যের যে বৃদ্ধি সাধন করে তাকে মূলধন গঠন বলে। অধ্যাপক বেনহাম (Benham) বলেন "The amount which a community adds to its capital during a period is known as capital formation during that period." মানুষ তার আয়ের সবটুকু অংশই ভোগ করে না; সে এর থেকে কিছু অংশ সঞ্চয় করে। এই সঞ্চয় থেকে মূলধন সৃষ্টি হয়। তবে সঞ্চয় মানেই মূলধন নয়। সঞ্চয়ের যে অংশ নতুন শিল্প- কারখানা, যন্ত্রপাতি, রাস্তাঘাট যানবাহন ইত্যাদিতে বিনিয়োগ করা হয় তাই হল মূলধন গঠন। সংক্ষেপে বলা যায় যে, একটি নির্দিষ্ট সময়ে বা কালে কোন দেশ তার বর্তমান পুঁজি যে পরিমাণ বাড়াতে পারে বা সমর্থ হয় সেটাই তার পুঁজিগঠন বা বিনিয়োগের পরিমাণ। মূলধন গঠন কি কি বিষয়ের উপর নির্ভর করে মূলধন গঠন সঞ্চয়ের উপর নির্ভরশীল।
মূলধন গঠন প্রধানতঃ তিনটি বিষয়ের উপর নির্ভর
করে; যথা - (১) সঞ্চয়ের সামর্থ, (২) সঞ্চয়ের ইচ্ছা এবং (৩) বিনিয়োগের সুযোগ-সুবিধা।
১. সঞ্চয়ের সামর্থ
মানুষের সঞ্চয়ের সামর্থ তার আয়ের পরিমাণের উপর নির্ভরশীল। আয় যত বেশি হবে সঞ্চয়ের সামর্থ তত বেশি হবে। মানুষের আয় থেকে তাঁদের জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহের পরও যদি কিছু উদ্বৃত্ত থাকে তাহলে সঞ্চয় সম্ভব হয়। অতিরিক্ত আয় থেকে সঞ্চয় এবং সেই সঞ্চয়ই মূলধন গঠনে সাহায্য করে। সুতরাং সঞ্চয়ের সামর্থের উপরই মূলধনের পরিমাণ নির্ভর করে। বাংলাদেশের মত গরীব দেশের লোকের মাথাপিছু আয় কম, তাই তাদের সঞ্চয়ের সামর্থও কম। যে কোন দেশের আয়ের পরিমাণ, মূল্যস্তর, পরিবারের আয়তন, রুচি, অভ্যাস, কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা, জীবনযাত্রার মান ইত্যাদি সঞ্চয়ের সামর্থ নির্ধারণ করে।
২. সঞ্চয়ের ইচ্ছা
সঞ্চয়ের পরিমাণ শুধুমাত্র সঞ্চয়ের সামর্থের উপর নির্ভর করে না; সঞ্চয়ের ইচ্ছার উপরও নির্ভর করে। সঞ্চয় করবার ইচ্ছা না থাকলে কখনও সঞ্চয় হতে পারে না। কারণ, বাস্তবে দেখা যায় যে, কোন লোকের আয় অনেক, কিন্তু সে অমিতব্যয়ী, অপরিণামদর্শী। তাই তার কোন সঞ্চয় নেই, সঞ্চয়ের প্রতি কোন গুরুতব সে দেয় না। অথচ নিম্ন আয়ের লোক, যেমন গ্রামীন ব্যাংকের ঋণ কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত মহিলাদের ইচ্ছা থাকার কারণে এবং বাধ্যবাধকতা থাকায় তারা সঞ্চয় করতে আগ্রহী হন। দূরদৃষ্টি, পারিবারিক স্নেহ মমতা, উচ্চাকাংক্ষা, মর্যাদা লাভের ইচ্ছা, জানমালের নিরাপত্তা, সুদের হার, কর ব্যবস্থা, কৃচছতা অবলম্বন, পরিবেশগত অবস্থা প্রভৃতি বিয়ষগুলি সঞ্চয়ের ইচ্ছাকে প্রভাবিত করে। নিচে এগুলো সংক্ষেপে আলোচনা করা হল:
ক) দূরদৃষ্টি : মানুষের ভবিষ্যত সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। ভবিষ্যতে সন্তান-সন্ততিদের শিক্ষা, বিবাহ, নিজের অবর্তমানে সংসারের ভরণ-পোষণ ও নিরাপত্তা, ভবিষ্যত বিপদ-আপদে কোন কারণে অসুস্থ হয়ে পড়লে বা বার্ধক্যের কারণে অক্ষম হয়ে পড়লে - এসব বিপদ মোকাবিলা করতে দূরদৃষ্টি সম্পন্ন লোক সঞ্চয় করে। ফলে তাকে কারো গলগ্রহ হতে হবে না। সুতরাং যারা দৃষ্টি সম্পন্ন মানুষ তারা অধিক সঞ্চয় করে।
খ) পারিবারিক স্নেহ মমতা : পারিবারিক স্নেহ মমতা যে সমস্ত লোকের বেশি, তাদের সঞ্চয়ের ইচ্ছা তত প্রবল। এভাবে মাতাপিতা সন্তানের প্রতি স্নেহ মমতার বসবর্তী হয়ে তাদেরকে সুষ্ঠুভাবে লেখাপড়া শিখিয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠিত দেখতে অধিক পরিমাণে সঞ্চয় করে। ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য অধিক সহায় সম্পত্তি রেখে যাবার জন্যে লোকে বর্তমানে ত্যাগ স্বীকার করেই সঞ্চয় করে।
গ) উচ্চাকাংক্ষা ও মর্যাদা লাভের ইচ্ছা : সমাজে ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি লাভের আশায় মানুষ সঞ্চয় করে। বিশেষ করে বর্তমান যুগে যার টাকা পয়সা যত বেশি তার সামাজিক পরিচিতি, প্রভাব ও প্রতিপত্তি তত বেশি। ধনবান লোক সমাজে মর্যাদাবান। অনেকে মনে করেন পৃথিবী টাকার বশ। তাই উচ্চাকাংক্ষা সম্পন্ন ব্যক্তি সঞ্চয়ের মাধ্যমে তার ইচ্ছা পূরণ করে।
ঘ) জানমালের নিরাপত্তা : জানমালের নিরাপত্তার উপর সঞ্চয় অনেকাংশে নির্ভর করে। অনেক কষ্টে অর্জিত সঞ্চয় যদি সামাজিক নিরাপত্তার অভাবে নষ্ট হয়, এরূপ সমাজে সঞ্চয় গড়ে উঠা বিঘ্নিত হয়। তাই আইন-শৃংখলা ও জানমালের নিরাপত্তা সঞ্চয় গড়ে তোলার পূর্বশর্ত।
ঙ) সুদের হার : সঞ্চয়ের পরিমাণ অনেকটা সুদের হারের উপর নির্ভরশীল। সাধারণত: সুদের হার বেশি হলে সঞ্চয়ের আকাংক্ষা বৃদ্ধি পায়। সুদের হার কমে গেলে সঞ্চয়ের ইচ্ছা কমে যায়।
চ) কর ব্যবস্থা ও সরকারী নীতি : কর ব্যবস্থা ও সরকারী নীতিও সঞ্চয়ের ইচ্ছার উপর প্রভাব বিস্তার করে। কর ব্যবস্থা ও সরকারী নীতি যদি এরূপ হয় যে, সঞ্চিত অর্থের উপর কর দিতে হবে না তাহলে লোকে অধিক সঞ্চয় করতে আগ্রহী হবে। পক্ষান্তরে, সঞ্চয়ের উপর সরকার যদি কর বেশি করে ধার্য করে তবে সঞ্চয়ের প্রবৃত্তি হ্রাস পাবে।
ছ) শিক্ষা ও সামাজিক রীতি-নীতি : সঞ্চয়ের পরিমাণ দেশের সামাজিক রীতি-নীতি, শিক্ষা, ধর্ম প্রভৃতির উপর নির্ভর করে। সাধারণত: শিক্ষা প্রসারের সাথে সাথে লোকে তাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক কল্যাণ সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠে। তার ফলে সঞ্চয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
জ) কৃচছতা অবলম্বন : সামাজিক পরিবেশ, কৃষি ও জীবন যাত্রার ধরন সব মিলিয়ে যদি কোন সমাজ মিতব্যয়ী সমাজ হয়, অর্থাৎ কৃচছতা পালনে আগ্রহী হয় তবে সে সমাজে সঞ্চয়ের পরিমাণ বেশি হবে। যেমন, নেপালের মাথাপিছু আয় বাংলাদেশের চেয়ে কম অথচ সেখানে সঞ্চয়ের হার বেশি।
৩. বিনিয়োগের সুযোগ সুবিধা
বিনিয়োগের সুযোগ-সুবিধার উপর সঞ্চয় অনেকখানি নির্ভরশীল। দেশের মূলধনের নিরাপদ ও লাভজনক বিনিয়োগের সুযোগ-সুবিধা যত বেশি হবে সঞ্চয়ের পরিমাণ তত বৃদ্ধি পাবে। ব্যাংক, বীমা কোম্পানী, যৌথ মূলধনী কারবার প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানে নিরাপদ ও লাভজনক বিনিয়োগের সুবিধা যত বাড়বে সঞ্চয়ের প্রতি লোকের আগ্রহ তত বাড়বে। সামগ্রীকভাবে দেশের মূলধনের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে।
সুতরাং পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় উপরিলি-খিত কারণসমূহের উপর মূলধন গঠন নির্ভরশীল।
মূলধনের দক্ষতা
মূলধনের উৎপাদন ক্ষমতাকে মূলধনের দক্ষতা বুঝায়। মূলধন নিয়োগের ফলে দ্রব্যের উৎপাদন যে পরিমাণ বৃদ্ধি পায় তাকে মূলধনের উৎপাদন ক্ষমতা বলে। উৎপাদনের আয় থেকে অন্যান্য উপাদান ও আনুষঙ্গিক ব্যয় বাদ দিয়ে মূলধন ব্যবহারের জন্য যে লাভ পাওয়া যায় তা হল মূলধনের উৎপাদনের ক্ষমতা। তবে প্রকৃতপক্ষে উৎপাদনে প্রত্যেকটি উপাদানের অবদান কতটুকু তা নির্ধারণ শক্ত ব্যাপার। যে মূলধন পণ্যের প্রান্তিক উৎপাদন ক্ষমতা সর্বাধিক, উৎপাদনকারী সেই মূলধন পণ্য ব্যবহারে তত আগ্রহী। কোন কোন বিষয়ের উপর মূলধনের ক্ষমতা নির্ভর করে।
নিম্নে বর্ণিত বিষয়সমূহের উপর মূলধনের উৎপাদন ক্ষমতা নির্ভর করে :
১) উৎপন্ন দ্রব্যের চাহিদা : উৎপন্ন দ্রব্যের চাহিদার উপর মূলধনের দক্ষতা নির্ভর করে। উৎপন্ন দ্রব্যের চাহিদা বৃদ্ধি পেলে সেখানে উৎপাদনকারী আরো মনোযোগী হয়, বৈচিত্র্যময় দ্রব্য উৎপাদন করে এবং মূলধনের দক্ষতা বৃদ্ধি পায়।
২) উন্নত প্রযুক্তি ও উৎপাদন পদ্ধতি : উন্নত প্রযুক্তি ও উৎপাদন পদ্ধতি প্রয়োগের উপর মূলধনের উৎপাদন ক্ষমতা নির্ভর করে। পুরাতন যন্ত্রপাতির পরিবর্তে আধুনিক ও নতুন যন্ত্রপাতি অধিকতর উৎপাদনশীল ও দক্ষ।
৩) শ্রমিকের কর্মদক্ষতা : শ্রমিকের কর্মদক্ষতার উপর উৎপাদনের দক্ষতা নির্ভর করে। একই যন্ত্রপাতির সাহায্যে দক্ষ শ্রমিক অদক্ষ শ্রমিকের চাইতে অধিক উৎপাদন করে। বস্ত্তত: দক্ষ শ্রমিক ও আধুনিক যন্ত্রপাতি একত্রে মিলিয়েই এরূপ উৎপাদন সম্ভব হয়।
৪) মূলধনের পরিমাণ : উৎপাদন কাজে মূলধনের পরিমাণ পর্যাপ্ত হলে মূলধনের দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। মূলধনের পরিমাণ অপর্যাপ্ত হলে উৎপাদিকা শক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার বিঘ্নিত হয়। ফলে উৎপাদন কম হয়। সুতরাং মূলধনের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হলে মূলধনের পরিমাণ যথোপযুক্ত হতে হবে।
৫) মূলধনের মান : মূলধনের মান উন্নত হলে উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। উন্নত ও নতুন যন্ত্রপাতি পুরাতন যন্ত্রপাতি অপেক্ষা অধিক উৎপাদনশীল।
৬) মূলধনের উপযুক্ত বিনিয়োগ : মূলধনের উপযুক্ত বিনিয়োগের দ্বারা এর উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি করা যায়। মূলধনের ব্যবহার যথার্থ না হলে তার উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস পায়।
৭) উৎপাদনে বৈচিত্র্য প্রবর্তন : উৎপাদন ক্ষেত্রে নতুন নতুন যন্ত্রপাতি আবিষ্কৃত হচ্ছে, বৈচিত্র্যময় উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে এবং মূলধনের প্রান্তিক উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এভাবে উপাদানের নতুন আবিষ্কার, কাঁচামালের নতুন উৎস আবিষ্কার, শিল্প কারখানাকে নতুনভাবে সংগঠিত করা হলে মূলধনের উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
৮) ব্যবসায়ীদের মনোভাব : মূলধন বিনিয়োগকারী ব্যবসায়ীগণ আশাবাদী হলে, ঝুঁকি গ্রহণে ইচ্ছুক হলে মূলধনের দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। অপরপক্ষে, নৈরাশ্য মূলধন ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করে।
পরিশেষে বলা যায়, দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার উপর মূলধনের উৎপাদন ক্ষমতা নির্ভর করে। ব্যবসা পরিচালনার দক্ষতা মূলধনের যথোপযুক্ত ব্যবহারকে নিশ্চিত করে।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions