উৎপাদন কাকে বলে
উৎপাদন : আপনি একটি চেয়ারে বসে পড়াশুনা করেন। প্রকৃতিতে তৈরি অবস্থায় চেয়ারটি পাওয়া যায় না। গাছ কেটে, প্রয়োজনমত চিরে, কাঠমিস্ত্রির সহায়তায় এটি তৈরি করতে হয়েছে। প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত গাছ থেকে সংগৃহীত কাঠের ধরন পরিবর্তন করে চেয়ার উৎপাদন করা হয়। প্রকৃতপক্ষে মানুষ কোন পদার্থ সৃষ্টি করতে পারে না। যদিও সাধারণতঃ উৎপাদন বলতে কোন দ্রব্য সৃষ্টি করা বুঝায়। কিন্তু অর্থনীতিতে উৎপাদন শব্দটি একটি বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত হয়। উৎপাদন বলতে অর্থনীতিতে উপযোগ সৃষ্টি বুঝায়। বস্ত্ততঃ মানুষ কোন পদার্থ সৃষ্টি করতে পারেনা, ধ্বংসও করতে পারে না। মানুষ শুধু প্রকৃতি প্রদত্ত কোন বস্ত্ত বা পদার্থের রূপান্তর বা আকারগত পরিবর্তন ঘটিয়ে উপযোগ সৃষ্টি বা বৃদ্ধি করতে পারে। অধ্যাপক মার্শাল বলেন, ‘‘এই বস্ত্তজগতে মানুষ যাহা করিতে পারে তা শুধু এই যে, সে বস্ত্তকে অধিকতর কার্যোপযোগী করিবার জন্য উহার পুনর্বিন্যাস করিতে পারে কিংবা বস্ত্তকে এমনভাবে স্থাপন করিতে পারে যাহাতে প্রকৃতি উহাকে অধিকতর কার্যোপযোগী করিয়া তোলে।’’ যেমন কৃষক বীজ হতে ফসল উৎপাদন করে; তাঁতী তুলা হতে কাপড় উৎপাদন করে। এ সকল দ্রব্যের বেশীরভাগ প্রকৃতির দান। মানুষ নিজের শ্রম, মেধা ও পুঁজি কাজে লাগিয়ে প্রকৃতি প্রদত্ত বস্ত্তকে অধিকতর উপযোগী করে তোলে। তাই উৎপাদন মানে উপযোগ বা কাম্যতা সৃষ্টি। অন্যকথায় উৎপাদন মানে হচ্ছে, দ্রব্যের ব্যবহারিক মূল্য সৃষ্টি করা। উপযোগ সৃষ্টি বিভিন্ন ধরনের হতে পরে। তুলাকে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করে কাপড়ের কল যে রঙিন শাড়ী তৈরি করে তার মূল্য তুলার মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি। এভাবে তুলার মূল্যের সাথে শাড়ীর মূল্য সংযোজিত হয়ে অতিরিক্ত মূল্য সৃষ্টি করে। অনুরূপভাবে লোহার টিনের সিট থেকে শিল্প শ্রমিক আলমারি তৈরি করে, কৃষক জমিতে আধুনিক উপকরণ (পানি সেচ ব্যবস্থা, সার, উফসী বীজ ইত্যাদি) ব্যবহার করে অধিক কৃষিপণ্য উৎপন্ন করে, শিক্ষক শিক্ষাদানের মাধ্যমে মানুষকে উন্নত জীবনের পথ নির্দেশ করে। এগুলো সবই উৎপাদনের কাজ।
উপযোগের শ্রেণীবিভাগ
মানুষ প্রধানত প্রকৃতি-প্রদত্ত পদার্থের আকার, স্থান, সময় ও মালিকানা পরিবর্তন ঘটিয়ে উপযোগ সৃষ্টি করে। তাই উপযোগকে প্রধানতঃ চারভাগে ভাগ করা হয়। যথা (১) রূপগত উপযোগ, (২) স্থানগত উপযোগ, (৩) সময় বা কালগত উপযোগ এবং (৪) হস্তান্তরযোগ্য উপযোগ।
১. রূপগত উপযোগ : প্রকৃতি প্রদত্ত কোন বস্ত্তর রূপ বা আকার পরিবর্তন করে যে উপযোগ সৃষ্টি করা হয় তাকে রূপগত উপযোগ বলা হয়। যেমন, কাঠের রূপ বা আকৃতি পরিবর্তন করে চেয়ার বা আসবাবপত্র তৈরি, তুলার রূপ পরিবর্তন করে কাপড় তৈরি করাকে রূপগত উপযোগ সৃষ্টি বলা হয়।
২. স্থানগত উপযোগ : কোন দ্রব্যকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে স্থানান্তর করে উপযোগ সৃষ্টি করা যায়। একে স্থানগত উপযোগ বলা হয়। যেমন, গ্রামাঞ্চল থেকে শাকসব্জি শহরে এনে এর উপযোগ সৃষ্টি বা বৃদ্ধি করা যায়। নদী থেকে মাছ শহরের বাজারে আনলে বেশি দামে বিক্রি হয়।
৩. সময় বা কালগত উপযোগ : কোন কোন দ্রব্যের উপযোগ সময়ের ব্যবধানের জন্য বিভিন্ন হয়ে থাকে। কোন দ্রব্য উৎপাদনের পর কিছুকাল মজুদ রাখলে উপযোগ বৃদ্ধি পায়। এরূপ উপযোগকে সময়গত বা কালগত উপযোগ বলে যেমন, ফসল কাটার পর কিছুকাল সংরক্ষণের পর বিক্রি করলে বেশি মূল্য পাওয়া যায়।
৪. হস্তান্তরযোগ্য বা মালিকানার উপযোগ: কোন এক ব্যক্তির কাছে কোন পণ্যের উপযোগ কম, অথচ ঐ পণ্যটির উপযোগ আরেক ব্যক্তির কাছে বেশি। এমতবস্থায়, পণ্যটি হস্তান্তর হলে উপযোগ বৃদ্ধি পায়। যেমন-গৃহস্থের বাড়ীতে নারিকেলের ছোবড়ার তেমন মূল্য নেই, কিন্তু ছোবড়া শিল্পের মালিকের কাছে এর মূল্য অনেক বেশি।
পণ্যের উৎপাদনের আলোচনার সঙ্গে সেবা কর্মের সৃষ্টি ও বৃদ্ধির আলোচনাও অন্তর্ভুক্ত। মানুষ তার শ্রম ও সেবা কর্মের দ্বারা যে উপযোগ বৃদ্ধি বা সৃষ্টি করে তাকে সেবাগত উপযোগ বলে। উৎপাদনের উপাদান কোন কিছু উৎপাদনের জন্য যে সকল বস্ত্ত বা সেবাকর্ম প্রয়োজন হয় ঐগুলিকে উৎপাদনের উপাদান বলা হয়। এগুলি হল ভূমি, শ্রম, মূলধন ও সংগঠন। যেমন-ধান উৎপাদন করতে হলে শুধু ভূমি হলেই চলবে না, অন্য তিনটি উপাদানেরও প্রয়োজন হয়। তেমনি শিল্পজাত দ্রব্য উৎপাদনে কেবলমাত্র কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি থাকলেই হবে না, একই সঙ্গে ভূমি, শ্রম, নগদ টাকা ও সংগঠন আবশ্যক। অবশ্য আধুনিককালে উপাদান হিসেবে শ্রমের সংগে সংগঠনকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
নিম্নে উৎপাদনের উপাদানসমূহ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হল :
১. ভূমি : সাধারণতঃ পৃথিবীর উপরিভাগকে ভূমি বলা হয়। কিন্তু অর্থনীতিতে ভূমি বলতে শুধু ভূ-পৃষ্ঠকেই বুঝায় না, বরং প্রাকৃতিক সকল সম্পদকে বুঝায়। অর্থাৎ মাটির উর্বরাশক্তি, আবহাওয়া, বৃষ্টিপাত, তাপ, জল, বাতাস, সূর্যের আলো, খনিজ সম্পদ, বন, মৎস্যক্ষেত্র, খাল-বিল, নদ-নদী, সমুদ্র প্রভৃতি যাবতীয় প্রাকৃতিক সম্পদ ভূমির অন্তর্গত। এ সমস্ত কিছুই প্রকৃতির দান। ইহা উৎপাদনের একটি আদি ও মৌলিক উপাদান।
২. শ্রম : উৎপাদন কার্যে নিয়োজিত মানুষের শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রমকে শ্রম বলে। শ্রমের মাধ্যমে মানুষ প্রকৃতি থেকে উপকরণ সংগ্রহ করে সেগুলিকে ব্যবহারের জন্য আরো উপযোগী করে তোলে। শ্রমও উৎপাদনের একটি আদি ও অপরিহার্য উপাদান। স্যার উইলিয়াম পেটি (ঝরৎ ডরষষরধহ চবঃু) বিষয়টিকে আকর্ষণীয়ভাবে বর্ণনা করে বলেছেন, ‘‘ উৎপাদনের শ্রমিক হল পিতা এবং ভূমি হল মাতা।’
৩. মূলধন : মানুষের শ্রম দ্বারা উৎপাদিত হয়ে যে বস্ত্ত সরাসরি ভোগে ব্যবহৃত না হয়ে পুনরায় উৎপাদনে ব্যবহৃত হয় তাকে মূলধন বলে। যেমন, যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল, ঘর,বাড়ী, কলকারখানা প্রভৃতি মানুষের উৎপাদিত দ্রব্য যা উৎপাদন কার্যে ব্যবহৃত হয় সেগুলিকে মূলধন বলা হয়।
৪ সংগঠন : আধুনিককালে উৎপাদনের বিভিন্ন উপাদানগুলিকে একত্রিত করে এগুলিকে উৎপাদন কার্যে নিয়োগ করার উদ্যোগকে সংগঠন বলে। উৎপাদন পদ্ধতির জটিলতা বৃদ্ধির সাথে সাথে সংগঠনের গুরুতব বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই দক্ষ সংগঠনের প্রয়োজন বেড়ে চলছে। যারা একাজ করে তাদেরকে উদ্যোক্তা বা সংগঠক বলে। সংগঠককে উৎপাদনের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হয়, পরিচালনার দায়িতব নিতে হয় এবং ব্যবসায়ের ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা বহন করতে হয়।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions