নিম খাজনা কাকে বলে?
নিম খাজনার সংজ্ঞা ও প্রকৃতি: উপাদান যোগানের অস্থিতিস্থাপকতা থেকে খাজনা সংক্রান্ত বিষয়ের উদ্ভব হয়। যেমন – উৎকৃষ্ট জমির যোগান স্থির, তাই জমির চাহিদা বাড়লে সেই জমির মালিকরা তা থেকে উদ্বৃত্ত (খাজনা) উপার্জন করতে পারে। তবে জমি ছাড়াও এমন কিছু উপকরণ বা সম্পদ আছে, যাদের যোগানও অন্ততঃ স্বল্পকালের জন্য সীমিত। যেমন – কলকারখানায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি | স্বল্পকালে পরিবর্তনযোগ্য নয়। ফলে সেসব যন্ত্রপাতি বা মূলধন সামগ্রীর যোগান স্থির বলে তা | থেকে উদ্বৃত্ত আয় আসতে পারে। এ ধরনের আয়কে অধ্যাপক মার্শাল নিম খাজনা বা খাজনা সদৃশ বলেছেন। সুতরাং স্বল্পকালে যন্ত্রপাতি বা মূলধন সামগ্রীর ন্যায় স্থির উপাদানের জন্য মালিক কর্তৃক প্রাপ্ত বাড়তি উপার্জনকে নিম খাজনা বলে। আধুনিক অর্থনীতিবিদরা মনে করেন যে, খাজনা শুধু জমির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, বরং যে কোন উপাদানের আয়ের মধ্যে খাজনা অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। এ ধারণার প্রেক্ষিতে নিম খাজনা আলোচিত হয়। এসবের যোগান বাড়াতে সময় লাগে। যেমন – ঢাকা নগরীতে লোকসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার ফলে আবাসিক সমস্যা প্রকট হয়ে উঠছে। এমতাবস্থায় নতুন নতুন বিল্ডিং তৈরী সময় সাপেক্ষ বলে পুরনো বাড়িঘরের ভাড়া অনেক বেড়ে গিয়েছে। পুরনো বাড়িঘরের জন্য মালিকের তেমন অতিরিক্ত খরচ করতে হয় না, অথচ বাড়তি ভাড়া সহজেই তার হাতে আসে।
এ ধরনের বাড়তি অর্থ, যা যোগানের সীমাবদ্ধতার কারণে অর্জিত হয়, সেই অর্থকে নিম খাজনা | বলা হবে। কিন্তু দীর্ঘকালে অনেক নতুন বাড়িঘর তৈরী হলে এবং সরকার গৃহ সমস্যার সমাধানে এগিয়ে এলে বাড়ি ভাড়াও কমে যেতে পারে। কাজেই স্বল্পকালীন নিম খাজনা দেখা দিলেও দীর্ঘকালে সেই খাজনা নাও থাকতে পারে।
সাধারণ খাজনা বা অর্থনৈতিক খাজনার সঙ্গে নিম খাজনার পার্থক্য
ভূমির যোগান সীমাবদ্ধ। ভূমির অস্থিতিস্থাপক যোগানের কারণে যে অতিরিক্ত অর্থ পাওয়া যায় তাকে অর্থনীতিতে খাজনা বলে। অপরদিকে প্রকৃতি প্রদত্ত নয়, কিন্তু মানুষের দ্বারা রূপান্তরিত উপকরণ (যেমন – মূলধন বা যন্ত্রপাতি) থেকে যে অতিরিক্ত আয় স্বল্পকালে পাওয়া যায়, তাকে নিম খাজনা বলে। অর্থনৈতিক খাজনা স্বল্পকাল ও দীর্ঘকাল উভয়ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কিন্তু নিম খাজনা স্বল্পকালীন বিষয়। অর্থনৈতিক খাজনা প্রকৃতি প্রদত্ত সম্পদের সঙ্গে জড়িত। অপরদিকে প্রকৃতি প্রদত্ত সম্পদকে রূপান্তরিত করে মানুষ যে সম্পদ প্রস্তুত করে সেই বাবদ প্রাপ্ত খাজনাকে নিম খাজনা বলে।
নিম খাজনাকে অপূর্ণাঙ্গ খাজনা কেন বলা যায়?
জমির ন্যায় অন্যান্য উপকরণের যোগান যদি নির্দিষ্ট থাকে, তবে সেই উপকরণগুলোর | যোগানও জমির ন্যায় অস্থিতিস্থাপক হয়। কিন্তু এমন হতে পারে যে, অন্যান্য উপকরণের | যোগানের অস্থিতিস্থাপকতা স্থায়ী নয়, তা সাময়িক। স্বল্পকালে সেই উপকরণের যোগান বাড়ানো বা কমানো না গেলেও দীর্ঘকালে তার যোগান স্থিতিস্থাপক হতে পারে। অর্থাৎ তাদের যোগান প্রয়ােজন অনুসারে বাড়ানো-কমানো যায়। কিন্তু জমির যোগান স্বল্পকাল ও দীর্ঘকাল উভয় ক্ষেত্রেই নির্দিষ্ট, অর্থাৎ সম্পূর্ণ অস্থিতিস্থাপক। তাই জমি থেকে প্রাপ্ত খাজনাকে পূর্ণাঙ্গ খাজনা বলা হয়। কিন্তু মানুষের তৈরি যন্ত্রপাতি ও সাজসরঞ্জাম এর যোগান স্বল্পকালে স্থির থাকতে পারে। কিন্তু দীর্ঘকালে এদের যোগান পরিবর্তন করা যায়। স্বল্পকালে অপরিবর্তনযোগ্য যন্ত্রপাতি বা সরঞ্জামের আয় নির্দেশ করার জন্য মার্শাল ‘অপূর্ণাঙ্গ খাজনা ধারণাটি ব্যবহার করেন। কিন্তু দীর্ঘকালে যেহেতু এদের যোগান পরিবর্তন করা যায়, তাই দীর্ঘকালে এই খাজনা আর থাকে না। নিম খাজনা স্বল্পকালের জন্য প্রযোজ্য হলেও দীর্ঘকালের জন্য তা খাজনাকে অপূর্ণাঙ্গ খাজনা বলে। তাদের মধ্যে স্বল্পকালে মৌলিক পার্থক্য নেই। তবে জমির খাজনা ও নিম খাজনার মধ্যে দীর্ঘকালে তফাৎ দেখা দেয়।
খাজনা, নিম খাজনা ও সুদের মধ্যে সম্পর্ক
সাধারণভাবে বলা হয় যে, জমির আয় হলো খাজনা। মনুষ্য সৃষ্ট যন্ত্রপাতি বা মূলধন থেকে প্রাপ্ত আয়কে নিম খাজনা বলে। আবার ঋণযোগ্য মূলধনের আয়কে সুদ বলে। সাধারণভাবে ধরে নেওয়া হয় যে, স্বল্পকাল ও দীর্ঘকাল উভয় ক্ষেত্রে জমির যোগান মোটামুটি অস্থিতিস্থাপক অর্থাৎ তেমন পরিবর্তনযোগ্য নয়। মানুষের সৃষ্ট মূলধন বা যন্ত্রপাতি স্বল্পকালে স্থির থাকলেও দীর্ঘকালে পরিবর্তনযোগ্য।
মূলধন ভাসমান ও স্থায়ী হতে পারে। কখনও ভাসমান স্থায়ী মূলধনে পরিণত হয়, আবার কখনও অবচয় তহবিলের দ্বারা স্থায়ী মূলধন ভাসমান মূলধনে রূপান্তরিত হয়। তবে ভাসমান মূলধনের যোগান দ্রুত পরিবর্তন করা সম্ভব হলেও স্থায়ী মূলধনের পরিবর্তন ততটা সহজসাধ্য নয়। স্থায়ী মূলধনের যোগান স্বল্পকালে অস্থিতিস্থাপক। আর স্থায়ী মূলধনের অস্থিতিস্থাপকতার কারণে প্রাপ্ত অতিরিক্ত উপার্জনকে নিম খাজনা বলে। কিন্তু ঋণযোগ্য মূলধনের যোগান স্বল্পকাল ও দীর্ঘকাল উভয় সময়ই মোটামুটি স্থিতিস্থাপক। এ ধরনের মূলধন থেকে প্রাপ্ত আয়কে সুদ বলে, তাকে নিম খাজনা বলা হয় না। মানুষের সম্পত্তি নানা ধরনের হতে পারে। যেমন – জমি, বাড়ি, কলকারখানা, স্থায়ী মূলধন সামগ্রী, ঋণযোগ্য মূলধন ইত্যাদি। কিন্তু এক এক ধরনের সম্পত্তি থেকে উপার্জিত আয়কে এক এক নামে অভিহিত করা হয়। যেমন জমি ও বাড়ি থেকে উপার্জিত অর্থকে খাজনা, স্থায়ী মূলধন সামগ্রী থেকে উপার্জিত অর্থকে নিম খাজনা এবং ঋণযোগ্য মূলধন থেকে উপার্জিত আয়কে সুদ বলে। কাজেই ভাসমান মূলধন যখন স্থায়ী মূলধনে পরিণত হয়, তখন সুদের পরিবর্তে নিম খাজনা বিবেচনায় এসে পড়ে। সুতরাং খাজনা, নিম খাজনা ও সুদ এদের পরস্পরের মধ্যে সাদৃশ্য আছে। অনেক সময় এদের মধ্যে পার্থক্যের সীমা রেখা টানা কঠিন হয়ে পড়ে।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions