রিকার্ডোর খাজনা তত্ত্ব
খাজনা তত্ত্ব সম্পর্কে ডেভিড রিকার্ডো যে বক্তব্য রাখেন তা খাজনা সম্পর্কিত অর্থনীতির একেবারে প্রথম বক্তব্য নয়। রিকার্ডোর পূর্বেও কোন কোন চিন্তাবিদ খাজনা সম্পর্কে মতামত প্রকাশ করেছেন। তবে রিকার্ডোর তত্ত্ব একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা হিসাবে অনেক অর্থনীতিবিদের কাছে মনে হয়েছে।
রিকার্ডোর খাজনা তত্ত্বের মূল কথা
রিকার্ডোর বক্তব্য অনুসারে প্রকৃতি প্রদত্ত ক্ষমতার কারণে অর্থাৎ জমির মৌলিক ও অবিনশ্বর গুণের কারণে জমি থেকে ফসল পাওয়া যায়। সেই ফসলের অংশ যা জমির মালিককে দেওয়া হয়, তাই হলো জমির খাজনা। প্রকৃতি অকৃপণভাবে মানুষকে জমির যোগান দেয়নি। তাই রিকার্ডো মনে করেন চাহিদার তুলনায় জমির যোগানের স্বল্পতার কারণে খাজনার উদ্ভব হয়। ভূমিবাদি অর্থনীতিবিদগণ মনে করতেন প্রকৃতির দয়ায় খাজনা পাওয়া যায়। কিন্তু রিকার্ডোর মতে প্রকৃতির কৃপণতাই খাজনার জন্য দায়ী। প্রকৃতি যদি কৃপণ না হত অর্থাৎ উর্বর জমি যদি অফুরন্ত পাওয়া যেত, তা হলে জমি থেকে খাজনার উৎপত্তি হত না। জমির পরিমাণ যেহেতু প্রয়োজনের তুলনায় কম, তাই খাজনার উৎপত্তি ঘটে।
রিকার্ডো আরও মনে করে, খাজনা হলো উৎপাদকের উদ্বৃত্ত। জমির উর্বরতার পার্থক্যের কারণে সেই উদ্বৃত্ত আয় বা খাজনা দেখা দেয়। একই দৃষ্টিকোণ থেকে খাজনাকে প্রার্থক্যজনিত আয় বলা যায়। বিভিন্ন জমির মধ্যে উর্বরতার পার্থক্য আছে। কোন জমি বেশি উর্বর এবং কোনটি কম উর্বর। প্রথমে বেশি উর্বর জমি চাষের আওতায় আসে। তারপর ফসলের চাহিদা বাড়লে ক্রমেই অনুর্বর জমি চাষের আওতায় আনতে হয়। যে জমি চাষ করার পর প্রাপ্ত ফসলের দাম দ্বারা কেবল চাষের খরচ নির্বাহ করা যায়, কিন্তু কোন উদ্বৃত্ত পাওয়া যায় না, সেই জমিকে প্রান্তি ক জমি বলে। প্রান্তিক জমির খাজনা নেই। প্রান্তিক জমির তুলনায় উর্বর জমিতে প্রাপ্ত অতিরিক্ত (খরচের উদ্বৃত্ত) ফসল হলো খাজনা।
রিকার্ডোর তত্ত্বের মূল বক্তব্য অনুসারে দুটি কারণে খাজনার উদ্ভব হয়।
সেই দু’টি কারণ কি কি?
১। যদি বিভিন্ন জমি সমজাতীয় হয়, অর্থাৎ গুণাগুণের দিক থেকে তারা যদি একই রকম হয়, তবে চাহিদার তুলনায় জমির স্বল্পতার কারণে খাজনা (Scarcity rent) দেখা দেয়।
২। যখন গুণগত দিক থেকে বিভিন্ন জমি বিভিন্ন রকম হয়, তখন উর্বরতা ও অবস্থানগত দিক থেকে নিকৃষ্ট জমির তুলনায় উৎকৃষ্ট জমিতে তারতম্যমূলক খাজনা (Differential rent) দেখা দেয়।
রিকার্ডোর খাজনা তত্ত্বের অনুমিতি :
১. সমগ্র সমাজের প্রেক্ষিতে বিবেচিত জমির যোগান সীমিত।
২. জমি যেহেতু প্রকৃতি প্রদত্ত, তাই তার যোগান মূল্য নেই। জমির দাম বাড়লেও যোগান বৃদ্ধির সুযোগ নেই।
৩. ক্রমহ্রাসমান উৎপাদন বিধি কার্যকর।
৪. জমির উৎপাদন ক্ষমতা তথা উর্বরতার পার্থক্যের কারণে খাজনার উৎপত্তি হয়।
৫. জমির মৌলিক ও অবিনশ্বর ক্ষমতা আছে।
রিকার্ডোর খাজনা তত্ত্বের উদাহরণভিত্তিক বিশ্লেষণ
উর্বরা শক্তির ভিত্তিতে জমিকে তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যাক : ১ম, ২য় ও ৩য়। ১ম শ্রেণীর জমিকে উৎকৃষ্ট, ২য় শ্রেণীর জমিকে মধ্যম এবং ৩য় শ্রেণীর জমিকে নিকৃষ্ট বলা হয়। ৩য় শ্রেণীর জমিকে প্রান্তিক জমি (সধৎক্সরহধষ ষধহফ) বলা হয়। প্রান্তিক জমির প্রাপ্ত ফসল ও সেই ফলে উৎপাদনের ব্যয় সমান। সেখানে কোন উদ্বৃত্ত পাওয়া যায় না। কাজেই প্রান্তিক জমি বাবদ কোন খাজনা দিতে হয় না। প্রান্তিক জমির তুলনায় ১ম ও ২য় শ্রেণীর জমিতে যে বাড়তি ফসল পাওয়া যায়, তার আর্থিক মূল্যকে খাজনা বলা হয়। ৩য় শ্রেণী অপেক্ষা ২য় শ্রেণীর জমিতে ফসল বেশী পাওয়া যায় এবং ২য় শ্রেণী অপেক্ষা ১ম শ্রেণীর জমিতে আরও বেশি ফসল পাওয়া যায়। তাই ৩য় শ্রেণীর (প্রান্তিক) জমির ভিত্তিতে ২য় শ্রেণীর জমি থেকে যতটা খাজনা পাওয়া যায়, তার তুলনায় ১ম শ্রেণীর জমিতে খাজনা বেশি হয়।
রিকার্ডোর খাজনা তত্ত্বের ত্রুটি বা সমালোচনা
রিকার্ডোর খাজনা তত্ত্বের বিভিন্ন ভাবে সমালোচনা করা হয়েছে। নিম্নে তাদের উল্লেখ করা হল –
১। জমি প্রকৃতি প্রদত্ত হলেও তার শক্তি অবিনশ্বর নয়। জমির উর্বরতা ক্ষয় হতে পারে। আবার বৈজ্ঞানিক চাষাবাদের মাধ্যমে জমির উর্বরতা বাড়ানো যেতে পারে। তাই জমির মৌলিক ও অবিনশ্বর শক্তি নির্ধারণ করা কঠিন।
২। জমির ব্যবহারকে কেবল একটি ক্ষেত্রে সীমিত রাখা যুক্তিযুক্ত নয়। যেমন – কোন জমি একটি বিশেষ ফসল উৎপাদনের উপযোগি হলেও সেই ফসলের জন্য সেই জমি সর্বদাই থাকবে, এটি ভেবে নেওয়া ঠিক নয়। একই জমি একাধিক ব্যবহারে নিয়োগ করা সম্ভব হলে ক্ষেত্র বিশেষে জমির যোগান কমানো বা বাড়ানো যায়।
৩। রিকার্ডো মনে করেন উৎকৃষ্ট জমি প্রথমে চাষাবাদের আওতায় আনা হয়, তারপর মধ্যম এবং সর্বশেষে নিকৃষ্ট জমি চাষাবাদ করা হয়। প্রকৃত অবস্থায় মানুষ প্রথমে জমির সঠিক শ্রেণী বিভাগ করতে পারে না। মানুষ তার নিজস্ব সুবিধা অনুসারে জমি চাষ শুরু করে। এমন হতে পারে যে, সে যে জমি প্রথমে চাষ করা শুরু করল, সেই জমি উর্বরতার দিক থেকে হয়ত সর্বোৎকৃষ্ট নয়। জমির অবস্থানগত দূরত্ব সে বিবেচনায় আনতে পারে। যেমন – কোন ব্যক্তি তার বাসস্থান থেকে দূরবর্তী জমিতে চাষাবাদ করার চেয়ে নিকটবর্তী জমিতে চাষাবাদ করতে বেশী আগ্রহী থাকবে। কোন জমি বেশী উর্বর, এ বিষয়টির উপর সে প্রথমে গুরুত্ব নাও দিতে পারে।
৪। রিকার্ডোর তত্ত্বে খাজনাবিহীন জমির কথা উল্লেখ করা হয়। কিন্তু খাজনা বিহীন জমি প্রকৃত অবস্থায় দেখা যায় না।
৫। রিকার্ডোর তত্ত্ব অনুসারে কেবল খাজনা দেখা দেয়। কারণ ভূমির যোগান সীমাবদ্ধ। কিন্তু পরবর্তী কালে অধ্যাপক মার্শাল দেখান যে, ভূমি ছাড়াও যে কোন দুষ্প্রাপ্য উপাদানের ক্ষেত্রে খাজনার উৎপত্তি হতে পারে।
৬। রিকার্ডোর তত্ত্বে বলা হয়েছে যে, জমির উর্বরতার পার্থকের কারণেই খাজনার উদ্ভব হয়। কিন্তু সব জমির উর্বরতা সমান হলেও ক্রমহাসমান প্রান্তিক উৎপাদন বিধি প্রয়োগের উপর খাজনার উৎপত্তি নির্ভর করতে পারে।
রিকার্ডোর খাজনা তত্ত্বের মূল বৈশিষ্ট্য
রিকার্ডোর খাজনা তত্ত্বের মূল বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নে উল্লেখ করা হলো :
১। খাজনাকে পার্থক্যজনিত আয় বলা হয়। জমির মধ্যে কোন জমি উর্বর এবং কোন জমি অনুর্বর। প্রথমে উর্বর জমি চাষের আওতায় আসে। তারপর ফসলের চাহিদা বাড়লে ক্রমেই অনুর্বর জমি চাষের আওতায় আনতে হয়। যে জমি চাষ করার পর প্রাপ্ত ফসলের দাম দ্বারা কোন উদ্বৃত্ত পাওয়া যায় না, কেবল খরচ নির্বাহ করা যায়, সেই জমিকে প্রান্তি ক জমি বলে। প্রান্তিক জমির খাজনা নেই। প্রান্তিক জমির তুলনায় উর্বর জমিতে প্রাপ্ত অতিরিক্ত ফসল হলো খাজনা।
২। জমির আদি ও অবিনশ্বর গুণের জন্য খাজনা দেয়। রিকার্ডো মনে করেন, প্রকৃতি প্রদত্ত ক্ষমতার কারণে জমি থেকে ফসল পাওয়া যায়। সেই ফসলের অংশ যা জমির মালিককে দেওয়া হয়, তা হলো জমির খাজনা।
৩। প্রকৃতি অকৃপণভাবে অর্থাৎ অসীমরূপে জমির যোগান দেয় নি। তাই রিকার্ডো মনে করেন উৎকৃষ্ট জমির যোগান অসীম নয় বলে খাজনার উদ্ভব হয়। রিকার্ডোর মতে প্রকৃতির কৃপণতাই খাজনার জন্য দায়ী।
৪। খাজনা এক ধরনের অনুপার্জিত আয়, যেখানে জমির মালিকের কোন শ্রম ব্যয় করতে হয় না। জমির মালিক বসে থেকে যে বাড়তি অর্থ পায়, তা প্রকৃত অবস্থায় অনুপার্জিত আয়।
অবস্থানগত খাজনা বলতে কি বুঝানো হয়?
জমির উর্বরতার পার্থক্যের উপর খাজনা নির্ভর করলেও খাজনার উৎপত্তি হিসাবে জমির অবস্থান যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে। যে জমির অবস্থান কৃষকের বাড়ি থেকে দূরে অথবা বাজার থেকে দূরে, সেই জমির অবস্থানগত অসুবিধা পরিলক্ষিত হয়। কাজেই দূরবর্তী অবস্থানের জমির খাজনা নিকটবর্তী জমির খাজনা অপেক্ষা কম হয়। আবার গ্রামের জমির তুলনায় শহরের জমিতে অবস্থানগত কারণে খাজনা বেশী হয়। আবার সেই নগরীর এক অঞ্চলের জমির তুলনায় অপর অঞ্চলের জমির চাহিদা বেশী থাকে। ফলে জমির খাজনাও বেশী হয়। কাজেই অবস্থানের তারতম্যের কারণে খাজনার মধ্যে বিভিন্নতা দেখা দেয়। অবস্থানগত কারণে যে জমির প্রাপ্তি ঘটে, সেই খাজনাকে অবস্থানিক খাজনা বলা যায়।
জমির অবস্থানের উপর খাজনা নির্ভর করে। উৎপন্ন ফসল থেকে শ্রম ও মূলধন বাবদ খরচ মিটানোর পর যে উদ্বৃত্ত পাওয়া যায় তাই হলো খাজনা। ফসল বিক্রি করে আয় পাওয়া যায় এবং ফসল উৎপাদন করতে ব্যয় হয়। উৎপাদন ব্যয় ও বিক্রয়জনিত আয় এই দুয়ের ব্যবধান থেকে উদ্বৃত্ত আসে। জমি যদি সমান উর্বরা সম্পন্নও হয়, তথাপি বাজার থেকে অবস্থানগত দূরত্বের কারণে খাজনা দেখা দিতে পারে। যদি কোন জমি বাজারের নিকটে থাকে, তবে ফসল বাজারে আনার জন্য পরিবহণ ব্যয় কম হয়। অপরদিকে দূরত্ব বেশী হলে পরিবহণ ব্যয় বেড়ে যায়।
কাজেই পরিবহন ব্যয় পার্থক্যের কারণে বাজারের নিকটবর্তী জমির খাজনা বেশী হয় এবং দূরবর্তী জমির খাজনা কম হয় বা খাজনা একেবারেই থাকে না। যদিও হয়ত বাজারের নিকটবর্তী জমি ও দূরবর্তী জমির উর্বরতার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। এ ধরনের অবস্থানগত কারণে খাজনা বা উদ্বৃত্ত দেখা দিলে সেই খাজনাকে অবস্থানজনিত খাজনা বলা হবে।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions