বাজেট কি?
প্রতিটি পরিবারই মাসের প্রথমে ঐ পরিবারের মাসিক খরচের পরিমাণ স্থির করে। যেমন –এই মাসের খাদ্য, পোশাক, বাসস্থান, বিনোদন, শিক্ষা, চিকিৎসা প্রভৃতি খরচ। এই খরচের পরিমাণ নির্ভর করে ব্যক্তির আয়ের উপর। যে ব্যক্তির আয় কম সে সর্বক্ষেত্রে কম ব্যয় করে আবার যে ব্যক্তির আয় বেশি সে বেশি ব্যয় করে। আবার কোন একটি নির্দিষ্ট দ্রব্যের বা সেবার পিছনে খরচ বেশি হলে অন্য দ্রব্য বা সেবার খরচ কমিয়ে দেয়। অথবা অন্য কোন উৎস হতে ধার করে। আর এভাবেই ব্যক্তি তার আয়-ব্যয়ের হিসাব করে থাকে। এই নির্দিষ্ট সময়ের জন্য গৃহীত আর্থিক পরিকল্পনাকেই বাজেট বলে। বাজেট তৈরীর প্রধান কারণ হল আয়ের সীমাবদ্ধতা।
তাহলে আয়ের উৎস, ব্যয়ের খাতসমূহ, ব্যয়ের খাতের মধ্যে কোন খাতে কি পরিমাণ ব্যয় হবে ইত্যাদি সার্বিক হিসাব-নিকাশই হচ্ছে বাজেট।
বাজেট শব্দটি ফরাসী শব্দ 'Bougette' হতে উৎপন্ন। এই ফরাসী শব্দটির অর্থ হল ব্যাগ বা থলে। বৃটিশ অর্থমন্ত্রী ১৭৩৩ সালে কমন্স সভায় সর্বপ্রথম বাজেট শব্দটির গোড়াপত্তন করে। সেই থেকে বাজেট শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
সরকারী অর্থব্যবস্থায় বাজেট হচ্ছে সরকারী আয়-ব্যয়ের হিসাব। এই কথাটি বাজেট শব্দটির জন্য পর্যাপ্ত নয়। বর্তমানে বাজেট অর্থনৈতিক নীতি, নিয়োগ বৃদ্ধি, বিনিয়োগ গঠন, সঞ্চয়, বিনিয়োগ স্থানান্তর ও প্রবণতা, ঋণ গ্রহণ, সুষম আয় ও বন্টন, সম্পদের কাম্য ব্যবহার, কর্মসংস্থান, উৎপাদন, বেকারত্ব প্রভৃতিকে অন্তর্ভুক্ত করে। আর তাই বাজেটকে উঁচু দরের আর্থিক পরিকল্পনা বলা হয়।
বাজেটের গুরুত্ব :
আধুনিক অর্থনীতিতে বাজেটের গুরত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। সাধারণভাবে বাজেট সরকারের এক বৎসরের সম্ভাব্য আয়-ব্যয়ের হিসাব। বাজেটের একদিকে সরকারী আয়ের উৎসসমূহ ও আয়ের পরিমাণ এবং অপরদিকে ব্যয়ের খাতসমূহ এবং প্রস্তাবিত ব্যয়ের পরিমাণ দেখানো হয়।
আধুনিককালে সরকার বাজেটের মাধ্যমে বিভিন্ন অর্থনৈতিক নীতি বাস্তবায়ন করে। বর্তমান বাজেটের মুখ্য উদ্দেশ্য নিয়োগ বৃদ্ধি করা। নিয়োগ বৃদ্ধির প্রধান শর্ত হচ্ছে বিনিয়োগের হার বৃদ্ধি করা। অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশে বেসকারী বিনিয়োগের পরিমাণ আশানুরূপ না হওয়ায় সরকার বাজেটের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দেশের বিনিয়োগের হার বৃদ্ধি করে। সুতরাং কাঙ্খিত স্তরে বিনিয়োগ পৌঁছানোর জন্য বাজেট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভোগ ব্যয় হ্রাস করে সম্পদ বিনিয়োগে স্থানান্তর, সঞ্চয় ও বিনিয়োগের প্রবণতা বৃদ্ধি, জনগণের নিকট হতে কর আদায় করে উহা উৎপাদনশীল কাজে ব্যয় করা প্রভৃতি কাজে বাজেট সয়ংক্রিয় ভূমিকা পালন করে। তাহলে আমরা দেখছি যে, বাজেটে প্রকৃতি এবং প্রয়োগের ক্ষেত্র অবস্থা ভেদে কখনও অনুকূলে আবার কখনওবা প্রতিকূলে যায়।
এখন আসুন আমরা প্রকারভেদ অনুযায়ী বাজেটের গুরুত্ব আলোচনা করি –
সুষম বাজেট :
সুষম বাজেটের সংজ্ঞামতে সরকারী আয় ব্যয়ের মধ্যে সকল অবস্থায় ভারসাম্য বজায় রাখা উচিত। এ বাজেটে ব্যয়ের পরিমাণ কখনও আয় অপেক্ষা বেশী হওয়া উচিত নয়।
আমাদের সার্বিক অর্থনীতিতে সুষম বাজেটের প্রভাব হল –
প্রথমত : সুষম বাজেট নীতি অনুযায়ী বাজেট প্রণয়ন করলে সরকারের পক্ষে মিতব্যয়ী হওয়া সম্ভব। সরকার যখন আয় অনুযায়ী ব্যয় করে, তখন স্বভাবতঃই অত্যধিক ব্যয় করার প্রবণতা হ্রাস পায়। ফলশ্রুতিতে সরকারের পক্ষে দেউলিয়া হবার আশংকা কমে যায়।
দ্বিতীয়ত : এই বাজেট নীতি অনুসরণ করলে মুদ্রাস্ফীতির সম্ভাবনা কম থাকে। কারণ কোন অবস্থায় একবার মুদ্রাস্ফীতি ঘটলে এবং তার জন্য ঘাটতি বাজেট নীতি অনুসরণ করলে সবসময়ই ঘাটতি বাজেট নীতি অনুসরণ করতে হবে। এই চক্র হতে বের হয়ে আসা তখন কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
তৃতীয়ত : সুষম বাজেট সমাজে আয় বৈষম্য বৃদ্ধি করেনা। কারণ ঘাটতি বাজেটের ফলে সরকার ঋণ গ্রহণ করে পরিচালিত হয়। আর এই ঋণের বোঝা সাধারণ লোকের উপর কর ধার্য করে আদায় করা হয়। কিন্তু এই ঋণের অর্থ ঋণ প্রদানকারী ধনী শ্রেণীই পেয়ে থাকে। ফলে আয় বৈষম্য আরো বৃদ্ধি পায়।
চতুর্থত: সুষম বাজেট দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা সম্বন্ধে জনসাধারণের আস্থা বৃদ্ধি করে। এর ফলে ব্যক্তিগত বিনিয়োগ বৃদ্ধির সম্ভাবনা থাকে।
ঘাটতি বাজেট :
আধুনিক অর্থনীতিবিদগণ সুষম বাজেট নীতি সমর্থন করেন না। দেশের পূর্ণ-কর্মসংস্থানের স্তর বজায় রাখা ও দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং জনসাধারণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন প্রভৃতির জন্য সুষম বাজেট নীতি অপেক্ষা ঘাটতি বাজেট নীতির গুরুত্ব বেশী। কারণ –
প্রথমত : জাতীয় অর্থনীতি ভারসাম্য আনার চেষ্টা না করে শুধু বাজেটে সমতা আনয়নের চেষ্টার কোন যুক্তি নেই। বরং আয়কর, জীবনযাত্রার মান প্রভৃতি উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনবোধে ঘাটতি বাজেট অনুসরণ করা উচিত।
দ্বিতীয়ত : বর্তমানে প্রত্যেক দেশের রাজস্বনীতির প্রধান লক্ষ্য সমাজে পূর্ণ-কর্মসংস্থানের স্তর বজায় রাখা। এ জন্য বাণিজ্যচক্রকালীন বাজেট প্রণয়ন করা যেতে পারে। আর তা হল অসম বাজেট নীতি। বাণিজ্য চক্রের সময় ব্যক্তিগত আয় ও বিনিয়োগ হ্রাস পায়। এ সময় সরকার যদি ঘাটতি বাজেট নীতির অনুসরণে গঠনমূলক কাজে অর্থ ব্যয় করে, তবে দেশে পূর্ণ কর্মসংস্থানের স্তর থাকে। এ সময়ে কেবল আয়-ব্যয়ের সমতার উপর গুরুত্ব আরোপ করলে দেশের কর্মসংস্থানের পরিমাণ হ্রাস পায় এবং দেশে সমস্যা দেখা দেয়। সূতরাং ব্যবসায়বাণিজ্যের মন্দার সময় সরকারের পক্ষে ঘাটতি ব্যয় নীতি অনুসরণ করা যুক্তিসঙ্গত।
তৃতীয়ত : একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য প্রচুর মূলধন প্রয়োজন। কিন্তু অনুন্নত দেশের জনগণের মাথাপিছু আয় এবং কর প্রদানের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ। সুষম বাজেটের মাধ্যমে সরকারের পক্ষে উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধন কর হতে সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। এরূপ অবস্থায় অর্থনৈতিক উন্নয়নকে গতিশীল করতে সরকারকে অবশ্যই ঘাটতি বাজেট নীতি অবলম্বন করতে হবে।
চতুর্থত : এটা মনে করা যেতে পারে যে, ঘাটতি বাজেটের ফলে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিতে পারে। কিন্তু দেশে যদি প্রচুর সম্পদ অব্যবহৃত থাকে তাহলে ঘাটতি বাজেট নীতি গ্রহণ করা হলেও মুদ্রাস্ফীতির সম্ভাবনা থাকে না। কারণ ঘাটতি বাজেটের ফলে একদিকে যেমন ব্যয় বৃদ্ধি পায় তেমনি দেশের উৎপাদনও বৃদ্ধি পায়। সুতরাং পূর্ণ নিয়োগ স্তরের পূর্ব পর্যন্ত ঘাটতি বাজেট নীতি প্রণয়নের ফলে মুদ্রাস্ফীতির কোন সম্ভাবনাই থাকে না। অবশ্য উন্নয়নশীল দেশে ব্যয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদন বৃদ্ধি পায় না বলে ঘাটতি বাজেটের ফলে কিছুটা মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিতে পারে। তবে সরকারের সজাগ দৃষ্টি থাকলে এবং উন্নয়ন প্রচেষ্টাগুলি সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত হলে এই সমস্যা তেমন প্রকট হবার সম্ভাবনা থাকে না। তাছাড়া এই মৃদু মুদ্রাস্ফীতি ক্ষতিকর নয় বরং এটা দেশের উৎপাদন ও বিনিয়োগে উৎসাহ বৃদ্ধি করে।
পঞ্চমত : সাধারণভাবে মনে হতে পারে, ঘাটতি বাজেট দেশের অর্থনৈতিক দূর্বলতার প্রতীক। কিন্তু এই ধারণা ঠিক নয়। কারণ, দেশের কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকে লক্ষ্য না। রেখে শুধু সমতাপ্রাপ্ত বাজেটে কোন সার্থকতা নেই। এ ধরনের সমতাপ্রাপ্ত বাজেটে অর্থ হল অতিরিক্ত কর ধার্য করা। এভাবে অতিরিক্ত কর ধার্য করে বা সরকারী ব্যয় হ্রাস করে সমতাপ্রাপ্ত বাজেট প্রণয়ন করা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও নিরর্থক। এর দ্বারা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার দুর্বলতা এবং অযোগ্যতাই প্রমাণিত হয়। এ কারণে ঘাটতি বাজেট নীতি প্রণয়ন কখনই দুর্বলতার পরিচায়ক নয় বরং দেশের উন্নয়ন ও পূর্ণ-কর্মসংস্থানের জন্য একান্ত অপরিহার্য।
রাজস্ব বাজেট :
এবার আসুন আমরা রাজস্ব বাজেটের প্রভাব আলোকপাত করি। ধরুন আপনি বাজারে গেলেন আলু অথবা কোন দ্রব্য কিনতে। গিয়ে দেখলেন আলুর দাম বেড়ে গেল। স্বভাবতঃই আপনার আলু কেনার প্রবণতা কমে যাবে। আর এই দাম বৃদ্ধির কারণ যদি হয় সরকারী রাজস্বনীতি, তাহলে আমরা বলতে পারি, কর আরোপের ফলে কোন দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির জন্য মানুষের ঐ দ্রব্যের ভোগের প্রবণতা কমে যায়। আর ভোগের প্রবণতা হ্রাস পেলে মানুষের সঞ্চয়ের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। কারণ MPC + MPS = 1 অর্থাৎ ভোগের প্রান্তিক প্রবণতা ও সঞ্চয়ের প্রান্তিক প্রবণতার যোগফল ১। তাই একটির প্রবণতা হ্রাস পেলে অন্যটির প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। এ থেকে বলা যায় কর আরোপের জন্য মূল্যস্তরের উর্ধ্বগতির ফলে মানুষের সঞ্চয়ের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। যা অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি প্রধান পূর্বশর্ত।
উন্নয়ন বাজেট :
একটি দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে উন্নয়নমূলক বাজেটের প্রভাব অপরিসীম। এখন। আসুন আমরা এর প্রভাব বিশদভাবে বিশ্লেষণ করি –
শিক্ষাক্ষেত্রে : শিক্ষা সম্প্রসারণ, শিক্ষার হার বৃদ্ধি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গঠন শিক্ষকদের ভাতা প্রভৃতি ক্ষেত্রে সরকার বিভিন্ন উন্নয়নমূলক বাজেট প্রণয়ন করে।
স্বাস্থ্যক্ষেত্রে : বিভিন্ন হাসপাতালের গঠন ও উন্নয়ন, ডাক্তারদের বেতন, হাসপাতালের রক্ষণাবেক্ষণ, ঔষধ ও প্রয়োজনীয় জিনিসের সরবরাহ ইত্যাদি প্রদানের মাধ্যমে সরকার তার। উন্নয়নমূখী কর্মকান্ডের পরিচালনা ঘটায়।
বাসস্থান : সরকারী কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বাসস্থানের নিশ্চয়তা, দুস্থ ও বন্যা দুর্গত এলাকা এবং যুদ্ধের সময় বাসস্থানের সহায়তা প্রদান সরকারী উন্নয়নমুলক বাজেটের একটি প্রধান খাত।
সামাজিক : উপরোক্ত কার্যাদি সম্পাদন ছাড়াও বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান যেমন – মসজিদ, মন্দির, গীর্জা প্রভৃতি, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান যেমন – সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ইত্যাদি গঠন ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সরকার তার উন্নয়নমূলক বাজেটের একটা বড় অংশ ব্যয় করে।
বিবিধ : এছাড়া সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এবং রাস্তাঘাট প্রভৃতি উন্নয়নে সরকার প্রচুর ব্যয় করে থাকে এবং তা উন্নয়নমূলক বাজেটের প্রভাব।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions