কর কি?
অথবা
কর কাকে বলে?
সাধারণভাবে, জনগণ বাধ্যতামূলকভাবে সরকারকে যে অর্থ প্রদান করে তাই কর। একটি | দেশের সরকার তার ব্যয় নির্বাহের জন্য যে আয় করে থাকে তার একটি বড় অংশ আসে
জনগণের প্রদত্ত কর হতে। একটি দেশের প্রতিটি নাগরিক তার আয়ের একটি অংশ সরকারকে প্রদান করে। আর সরকারের ব্যয় নির্বাহের জন্য প্রদত্ত এই অর্থ প্রদান প্রতিটি উপার্জনক্ষম নাগরিকের জন্য বাধ্যতামূলক। আর এই অর্থ দ্বারাই নির্মিত হয় রাস্তা-ঘাট, সরকারী হাসপাতাল, সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি। এই সমস্ত উপাদান আমরা নিত্য ব্যবহার করে আসছি। কিন্তু আমি যদি হাসপাতাল ব্যবহার নাও করি তবুও আমাকে কর প্রদান করতে হচ্ছে। আমি না করলেও আরও দশজন এটা ব্যবহার করছে। সুতরাং বলা যায় কর দ্বারা কোনরূপ প্রত্যক্ষ প্রাপ্তি আশা করা যায় না। তাহলে বলা যায় যে, কোনরূপ প্রত্যক্ষ সুবিধার প্রত্যাশা না করে জনগণ বাধ্যতামূলকভাবে সরকারকে যে অর্থ প্রদান করতে হয় তাকে কর বলে।
বৈশিষ্ট্য :
উপরের আলোচনা হতে আমরা দেখি যে, প্রতিটি নাগরিক কর প্রদান করে কিন্তু বিনিময়ে যে সরকার হাসপাতাল বা রাস্তাঘাট সুবিধা দিতে বাধ্য নয়। তাহলে আমরা করের দুটি বৈশিষ্ট্য পাই –
১. কর প্রদান বাধ্যতামূলক
২. করদাতা কর প্রদানের জন্য কোনরূপ প্রত্যক্ষ সুবিধা দাবী করতে পারে না।
করের উদ্দেশ্য :
স্বভাবতঃই প্রশ্ন জাগতে পারে – কর থেকে যদি কোন প্রত্যক্ষ সুবিধা না-ই পাওয়া যায় তবে কেন কর দিব? এর সমাধান পেতে হলে আমাদের কর প্রদানের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে হবে।
১. রাজস্ব সংগ্রহ : কর ব্যবস্থা মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে রাজস্ব সংগ্রহ করা। দেশের নিরাপত্তা, অভ্যন্তরীণ শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা, বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক ও সেবামূলক কাজ করার জন্য সরকারকে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়। এই অর্থের যোগানের মূল উৎস কর। সুতরাং বলা যায় রাজস্ব সংগ্রহ করাই কর ব্যবস্থার মুখ্য উদ্দেশ্য।
২. উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ : অনেক সময় বিদেশ হতে আমদানীকৃত দ্রব্যের কম মূল্যের কারণে দেশীয় দ্রব্য কম বিক্রি হয়। ফলে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কাঙ্ক্ষিত মুনাফা অর্জন করতে পারে না। তাই দেশী শিল্প প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে সরকার আমদানীকৃত দ্রব্যের উপর উচ্চহারে কর আরোপ করে আমদানী খরচ বাড়িয়ে দেয়। ফলে দেশীয় বাজারে উহার মূল্য বেড়ে যায় এবং দেশী পণ্যের বিক্রি বেশি হয়। এভাবে কর আরোপের মাধ্যমে সরকার উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করে।
৩. ভোগ নিয়ন্ত্রণ : কর ব্যবস্থার আর একটি প্রধান উদ্দেশ্য ভোগ নিয়ন্ত্রণ করা। তা হল – বিলাসজাত দ্রব্যের ভোগ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সরকার তার উপর উচ্চহারে কর ধার্য করে। এছাড়া মদ, আফিম প্রভৃতি ক্ষতিকারক দ্রব্যের ব্যবহারও নিরুৎসাহিত করার লক্ষ্যে এগুলোর উপর অতিরিক্ত কর ধার্য করা হয়।
৪. বাণিজ্যচক্র নিয়ন্ত্রণ : বাণিজ্যচক্রের ফলে কোন দ্রব্যের দাম পরিবর্তিত হলে সরকার সেই শূন্যস্থান পূরণের জন্য ভর্তুকি দেয়। ফলে বাজারে আবার ভারসাম্য ফিরে আসে। এই ভর্তুকি প্রদানের অর্থ সরকার কর থেকে সংগ্রহ করে।
৫. সম্পদ ও আয়ের সুষম বন্টন : দেশের সম্পদের ন্যায়সঙ্গত বন্টন এবং সমাজের আয় বৈষম্য দূরীকরণের উদ্দেশ্যে কর ধার্য করা হয়। ধনী ব্যক্তিদের উপর ক্রমবর্ধমান হারে কর ধার্য করে ধনী দরিদ্রের আয় বৈষম্য দূর করা যায়।
৬. অর্থনৈতিক উন্নয়ন : অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশে কর ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হল অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন করা। সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য অর্থ সংগ্রহের নিমিত্তে কর ধার্য করা হয়। সুতরাং রাজস্ব সংগ্রহ করা ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে কর ধার্য করা হয়। তাহলে বলা যায় যে, সরকারী কাজকে অর্থায়নের সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি হল কর।
করের কানুনসমূহ :
কর ধার্য বা আদায় করার জন্য সরকার কতগুলো নিয়মকানুন মেনে চলে। এই নিয়মগুলোই করের কানুন। কারণ কর আদায় করার জন্য যে খরচ হয় তা প্রদত্ত করের চেয়ে বেশী হবে সেটি কোন অবস্থায়ই কাম্য নয়। তাই কর আদায়ের জন্য যে কানুনসমূহ মেনে চলা হয় তা হল –
১. সমতার কানুন।
নিশ্চয়তার কানুন
৩. সুবিধার কানুন।
৪. মিতব্যয়িতার কানুন।
উপরের চারটি নিয়মের প্রবক্তা এ্যাডাম স্মিথ। কিন্তু আধুনিক অর্থনীতিবিদগণ আরও কয়েকটি কানুনের উল্লেখ করেছেন –
৫. উৎপাদনশীলতার কানুন
৬. স্থিতিস্থাপকতার কানুন
৭. সরলতার কানুন ও
৮. বিভিন্নতার কানুন।
১. সমতার কানুন : প্রত্যেক নাগরিক তার নিজ নিজ সামর্থ অনুযায়ী কর প্রদান করার নীতিই হল সামর্থ্য বা সমতার কানুন। একজন ব্যক্তি যখন রাষ্ট্রের আওতায় থেকে যে আয় বা সুবিধা ভোগ করে সে সেই অনুপাতেই রাষ্ট্রের কার্যনির্বাহের জন্য ব্যয়ভার বহন করে।
২. নিশ্চয়তার কানুন : এ নীতি অনুযায়ী করের পরিমাণ ও প্রদানের সময় সম্পর্কে করদাতা অবহিত থাকে। ফলে ব্যক্তি সহজেই তার অবশিষ্ট আয় এবং বাজেট তৈরি করতে পারে।
৩. সুবিধার কানুন : এ নীতি অনুযায়ী করদাতা তার সুবিধা অনুযায়ী কর প্রদান করে। যেমন – চাষীর নিকট থেকে ফসল উঠার পর কর আদায় করা উচিত। ব্যবসায়ীদের নিকট হতে বছর শেষে কর আদায় করা উচিত। কারণ সে সময় ব্যবসায়ের হিসাব-নিকাশ করা হয়।
৪. মিতব্যয়িতার কানুন : এ নীতি অনুযায়ী কর আদায় কর উত্তোলন খরচ অপেক্ষা বেশী হওয়া উচিত। কর আদায় কর উত্তোলন খরচ অপেক্ষা কম হলে তার কোন যৌক্তিকতা থাকে না।
৫. উৎপাদনশীলতার কানুন : কর ধার্যের উদ্দেশ্য রাজস্ব সংগ্রহ করা। সুতরাং প্রতিটি কর ধার্যের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যেন পর্যাপ্ত রাজস্ব সংগৃহীত হয়। অল্প পরিমাণে অর্থ আদায় হতে পারে এ রকম অসংখ্য কর অপেক্ষা অধিক অর্থ আদায় হতে পারে এ রকম অল্প কর ধার্য করা উচিত।
৬. স্থিতিস্থাপকতার কানুন : কর ব্যবস্থা এ রকম হওয়া উচিত যেন প্রয়োজনবোধে করের পরিমাণ হ্রাস-বৃদ্ধি করা যায়। সরকারী ব্যয় স্থিতিশীল নয়। তাই কর ব্যবস্থা দ্বারা এই অস্থিতিশীল ব্যয় নির্বাহের জন্য করের কানুনও অস্থিতিশীল হওয়া উচিত।
৭. সরলতার কানুন : কর ব্যবস্থা অত্যন্ত সরল এবং সাধারণের বোধগম্য হওয়া উচিত যাতে সাধারণ জনগণ করের সহজ হিসাব-নিকাশ করতে পারে। ফলে দুর্নীতি ও প্রবঞ্চনার স্থান থাকে না।
৮. বিভিন্নতার কানুন : এই নীতি অনুযায়ী প্রত্যেক ব্যক্তি কিছু না কিছু কর দিতে বাধ্য থাকে। কর ব্যবস্থায় বিভিন্ন প্রকার কর থাকার ফলে করভার সকলের উপর যথাসম্ভব সমভাবে বন্টিত হয়। তাহরে প্রত্যেক দেশে এবং কর ব্যবস্থাকে কার্যকরী করার উদ্দেশ্যে এই নীতিগুলি কার্যকর করা উচিত।
প্রগতিশীল কর : প্রগতিশীল কর ব্যবস্থায় একজন লোকের আয় বা সম্পত্তির পরিমাণ যত বেশি হয় তাদের। উপর ক্রমশ তত বেশি হারে কর ধার্য করা হয়। সুতরাং আয়ের পরিমাণ বা সম্পত্তির মূল্য বৃদ্ধির অনুপাতে যদি করের হার বৃদ্ধি পায় তবে তাকে প্রগতিশীল কর বলে।
অধধাগতিশীল কর : উচ্চ আয়ের উপর ক্রমশ কম হারে কর ধার্য করা হলে তাকে অধােগতিশীল কর বলে। অধােগতিশীল কর ব্যবস্থায় আয়ের স্তর যত বাড়তে থাকে করের হারও তত কমতে থাকে।
সমানুপাতিক কর : যে ব্যবস্থায় সবার উপর সমান হারে কর আরোপ করা হয় তাকে সমানুপাতিক কর বলে।
করের আপাত ভার ও চুড়ান্ত ভার :
ধরা যাক, আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে সিনেমা দেখতে যাচ্ছি। সিনেমার যে টিকেট ক্রয় করলাম তার দিকে তাকালে দেখা যাবে যে প্রমোদ কর নামে একটা অংশ আছে। এই করে আমরা প্রদান করছি। এখন কথা হচ্ছে যে, এই কর সিনেমা মালিকদের কাছ থেকে সরকার আদায় করে। আর আমরা করটি প্রদান করছি। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, কর আরোপিত হচ্ছে একজনের উপর আর প্রদান করছে অন্যজন। আবার কোন ক্ষেত্রে যার উপর কর আরোপিত সেই কর প্রদান করে। আবার এমনও হতে পারে যে, ক্রেতা ও বিক্রেতা আংশিকভাবে কর প্রদান করছে। তাহলে যার উপরে করের প্রাথমিক অবস্থিতি ঘটল সেটা আপাত ভার এবং যে কর প্রদান করছে তাকে করের চূড়ান্ত ভার বুঝায়। তাহলে আমরা বলতে পারছি যে, করের প্রাথমিক অবস্থিতিকে করাঘাত বা আপাত ভার এবং চূড়ান্ত অবস্থিতিকে করাপাত বা চূড়ান্ত ভার বলে।
বিক্রয় করের ক্ষেত্রে করের আপাত ভার বিক্রেতার উপর এবং চূড়ান্ত ভার ক্রেতার উপর অর্পিত হয়। আবার আয়করের ক্ষেত্রে করের আপাত এবং চূড়ান্ত ভার উভয়ই একজনের উপর পড়ে।
এখন আসুন কয়েকটি ক্ষেত্রে করের আপাত ও চুড়ান্ত ভার কে বহন করে তা পর্যালোচনা করি –
১. আয়কর : জনগণের আয়ের উপর যে কর ধার্য করা হয় তা আয়কর। আয়করের করঘাত ও করপাত করদাতার উপর পড়ে।
২. বিক্রয় কর : দ্রব্য-সামগ্রী বিক্রয়ের উপর যে কর আরোপ করা হয় তাই বিক্রয় কর। বিক্রয় করের করঘাত বিক্রেতার উপর কিন্তু করপাত ক্রেতার উপর পড়ে।
৩. ভূমি রাজস্ব : ভূমির মালিকের উপর আরোপিত কর ভূমি রাজস্ব কর। ভূমির মালিকই এ করের করাঘাত ও করপাত বহন করে। তবে ভূমির মালিক উৎপাদিত দ্রব্যের মূল্য বাড়িয়ে করের অর্থ ক্রেতাদের নিকট হতে আদায় করতে পারে। এতে করে করপাত কৃষিজাত দ্রব্যের ক্রেতাদের উপর পড়বে।
৪. আবগারি শুল্ক : দ্রব্যের উৎপাদন ও ভোগ দেশের মধ্যে সম্পন্ন হলে তার উপর আরোপিত করকে আবগারি শুল্ক বলে। কাপড়, চা, সিগারেট ইত্যাদির উপর আরোপিত কর আবগারি শুল্ক । এ শুল্কে করঘাত উৎপাদনকারীর উপর এবং করপাত ক্রেতার উপর পড়ে।
৫. আমদানী-রপ্তানী শুল্ক : আমদানী দ্রব্যের আমদানী শুল্ক এবং রপ্তানী দ্রব্যের উপর রপ্তানী শুল্ক আরোপিত হয়। এক্ষেত্রে আমদানী শুল্ক আমদানীকৃত দেশের নাগরিকদের বহন করতে হয়। অর্থাৎ করের চূড়ান্ত ভার নাগরিকের উপর অর্পিত হয়। আবার রপ্তানীকৃত দেশের নাগরিকরা রপ্তানী শুল্কের করপাত বহন করে।
৬. প্রমোদ কর : জনগণের আমোদ-প্রমোদ ব্যবস্থাদির উপর আরোপিত কর প্রমোদ কর। যেমন – সিনেমা, যাত্রা, থিয়েটার ইত্যাদির টিকেটের উপর যে কর আরোপিত হয় উহা প্রমোদ কর। এ করের করঘাত উদ্যোক্তাদের উপর এবং করপাত দর্শকদের উপর পড়ে।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions