শিক্ষা কি / শিক্ষা কাকে বলে
মানব সমাজের একটি মৌলিক কার্যপ্রক্রিয়া হল শিক্ষা। শিক্ষার ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘Education'। Education শব্দটির উদ্ভব হয়েছে ল্যাটিন শব্দ ‘এডুকেয়ার' (educare) থেকে। এডুকেয়ার শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘বড় করা বা পালন করা (Bring up)। গ্রিক চিন্তাবিদদের কাছে শিক্ষা হল বিকাশ সাধনের এক সুসংবদ্ধ ও সচেতন পদ্ধতি। গ্রিক পণ্ডিতগণ সার্বিক শিক্ষা বোঝাতে পাইডিয়া' (Paideia) কথাটি ব্যবহার করে থাকেন। শিক্ষা বলতে কেবল নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে শিক্ষার্থীর শিখন বা পাঠ গ্রহণ নয়, শিক্ষা হল সাফল্যের সঙ্গে ভবিষ্যতের সম্মুখীন হওয়ার জন্য শিক্ষার্থীর মাঝে প্রয়োজনীয় অভ্যাস এবং মনোভাব গড়ে তোলা।
শিক্ষার সংজ্ঞা (Definition of education)
সংকীর্ণ অর্থে শিক্ষা হচ্ছে আনুষ্ঠানিক বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসা ও অন্যান্য বৃত্তিমূলক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। বিধিসম্মতভাবে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নির্দিষ্ট পাঠ্যক্রম অনুযায়ী শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে পঠন-পাঠন পরিচালিত হয়। ব্যাপক অর্থে শিক্ষা হল এক ধরনের স্বয়ংশিক্ষা। এ অর্থে শিক্ষা কোনো সংগঠন, পরিবার বা প্রতিষ্ঠানের বিষয় নয়। শিক্ষা সমাজের জীবনধারার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, পরিবেশের এক সামগ্ৰকি প্রভাব।
অধ্যাপক ম্যাকেঞ্জির (Mackenzie) মতে, ব্যাপক অর্থে শিক্ষা বলতে মানুষের ব্যক্তিত্বের বিকাশ সাধন বা আত্মােপলব্ধিকেই বোঝায়। তিনি বলেছেন , “It (education) means, in this sense, the general process by which personality is developed and by which persons are enabled to realize their relations to one another and the universe in which they live.
ম্যাকেঞ্জি মনে করেন, শিক্ষা হল বিরামহীন প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়া জন্ম থেকে আমৃত্যু অব্যাহত থাকে। এ কারণে বলা হয়, ‘যতদিন বাঁচি ততদিন শিখি । মানুষের জীবনপথে চলতে চলতে নানা অভিজ্ঞতা অর্জন করে। এসব অভিজ্ঞতার প্রতিটিই কোনো না কোনো শিক্ষা লাভে সাহায্য করে। এ ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনো পন্থা-পদ্ধতির প্রয়োজন হয় না। এ কারণে বৃহত্তর অর্থে শিক্ষা হল সমগ্র জীবনের বহুমুখী অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান।
হোয়াইটহেড (Whitehead)- এর মতে, শিক্ষার একমাত্র বিষয় হল সর্বতোভাবে বিকশিত বা প্রকাশিত জীবন। তিনি 1616 , “There is only one subject matter of education, and that is life in all its manifestations”.
সমাজবিজ্ঞানী সামনার (W. G. Sumner) বলেছেন, বস্তুতপক্ষে শিক্ষা হচ্ছে শিশুর দৃষ্টিভঙ্গি, অনুভূতি এবং সক্রিয়তা বিকাশের নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা, যা সে স্বাভাবিকভাবে অর্জন করতে পারত না। (It is actually a continuous effort to impose on the child ways of seeing, feeling and acting which he could not have arrived at spontaneously).
এমিল ডুর্খেইম বলেছেন, জীবন যাপনের প্রস্তুতি হিসেবে পূর্ববর্তী প্রজন্মের চর্চিত ক্রিয়াই হল শিক্ষা। সমাজজীবনের চাহিদা পূরণের জন্য শিক্ষা শিশুর মধ্যে দৈহিক, নৈতিক ও বৌদ্ধিক শক্তিকে জাগ্রত ও বিকশিত করে। মার্কসীয় দর্শন অনুসারে শিক্ষা হল একটি সচেতন সামাজিক কর্ম। শিক্ষা হচ্ছে মানবিক এবং যৌক্তিক গুণাবলী বিকাশের একটি পদ্ধতি। ব্যক্তির পূর্ণাঙ্গ বিকাশই হল শিক্ষার উদ্দেশ্য। মাকর্সবাদীদের মতানুসারে শিক্ষা হল এক ধরনের যৌক্তিক উৎপাদন পদ্ধতি।
সামাজিকভাবে বসবাস করার জন্য, অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য, সুস্বাস্থ্যের জন্য যেসব কলাকৌশল আয়ত্ত করতে হয় তাই শিক্ষা। সুতরাং শিক্ষা হচ্ছে মানুষের আচরণিক পরিবর্তন। বয়োজ্যেষ্ঠদের ক্রিয়াকলাপ, পুঁথিগত জ্ঞান, অর্জিত অভিজ্ঞতা ইত্যাদি ব্যক্তির আচরণ, বিশ্বাস, মনোভাব, ব্যক্তিত্ব ইত্যাদি ক্ষেত্রে দৃশ্যমান পরিবর্তন সাধন করে। ব্যক্তির এ পরিবর্তনের মূলে রয়েছে শিক্ষা। শিক্ষা শিশুর সামাজিকীকরণের অন্যতম প্রভাবশালী বাহন। শিক্ষার উদ্দেশ্য হল ব্যক্তি-মানুষের সুপ্ত প্রতিভা বা ক্ষমতাসমূহকে প্রকাশিত ও পরিমার্জিত করা।
শিক্ষার বৈশিষ্ট্য (Characteristic of education)
আমরা শিক্ষা বলতে কী বুঝায় তা জানতে পেরেছি। এখন আমরা শিক্ষার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা করব।
প্রথমে দেখা যাক ব্যাপক অর্থে শিক্ষার কি কি বৈশিষ্ট্য রয়েছে:
(ক) ব্যাপক অর্থে শিক্ষা হল আনুষ্ঠানিক নিয়মবর্জিত জ্ঞান। এ শিক্ষার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনো ধারা অনুসরণ করা হয় না।
(খ) বৃহত্তর অর্থে শিক্ষা নির্দিষ্ট কোনো পাঠ্যক্রমের সাথে সম্পর্কযুক্ত নয়। দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে অর্জিত হয়।
(গ) এ ধরনের শিক্ষা সচেতনভাবে যেমন হয়, তেমনি অসচেতনভাবেও হতে পারে।
(ঘ) শিক্ষার মাধ্যমে ব্যক্তির অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ হয়। ব্যক্তিত্ব বিকাশেও শিক্ষা ভূমিকা অপরিসীম।
প্রাতিষ্ঠানিক বা সংকীর্ণ অর্থে শিক্ষার কতকগুলো বৈশিষ্ট্যের পরিচয় পাওয়া যায়। যেমন:
(১) শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক ধরনের সম্পর্ক থাকে। এক্ষেত্রে শিক্ষক শিক্ষা দেন এবং শিক্ষার্থীরা তা গ্রহণ করে।
(২) এখানে সুনির্দিষ্ট পাঠ্যক্রম, পঠন-পাঠন, পরীক্ষা-ব্যবস্থা, মূল্যায়ন, সফল শিক্ষার্থীদের স্বীকৃতি প্রদান প্রভৃতি বিদ্যমান।
(৩) এ ধরনের শিক্ষা মানুষ সচেতনভাবে গ্রহণ করে থাকে।
(৪) প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জনে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা এবং লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকে।
(৫) জ্ঞান, দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি এ শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ পেশাগত উন্নতি লাভ করে।
(৬) বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসা প্রভৃতি বিদ্যায়তনে এ ধরনের শিক্ষা প্রদান করা হয়। অর্থাৎ শিক্ষার
সাথে নানা প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ সম্পর্কযুক্ত থাকে।
(৭) সংকীর্ণ অর্থে শিক্ষার উদ্দেশ্য নির্দিষ্ট গণ্ডীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। এর উদ্দেশ্য হল কোনো বিশেষ বিষয়ে জ্ঞান অর্জন কিংবা কলাকৌশল আয়ত্ত করা।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions