শিক্ষা কত প্রকার
শিক্ষার শ্রেণিবিভাগ (Classification of Education)
শিক্ষাবিজ্ঞানীগণ শিক্ষাকে প্রধানত তিনভাগে বিভক্ত করেছেন। যথা:
১. অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা (Informal education);
২. উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা (Non-formal education) এবং
৩. আনুষ্ঠানিক শিক্ষা (Formal education)।
১. অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা:
ব্যাপক অর্থে শিক্ষাই হলো অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা। প্রাতিষ্ঠানিক বা পরিকল্পনা মাফিক শিক্ষার বাইরে মানুষ পরিবেশ ও সমাজ থেকে যে শিক্ষা লাভ করে তাকে অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা বলে। সমাজের মূল্যবোধ, বিশ্বাস, খাদ্যাভ্যাস, রুচিবোধ, সংস্কৃতি, নিয়মনীতি, বিনোদন ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষ এই শিক্ষা অর্জন করে।
২. উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা:
আনুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জন এবং বিশেষ শিখন চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে পরিচালিত শিক্ষামূলক কার্যক্রমকে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা বলা হয়। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেমন: ক. এ শিক্ষা ব্যবস্থা নমনীয়। শিক্ষা লাভের সময়, স্থান, বিষয়বস্তু, পদ্ধতি, কৌশল পূর্ব নির্ধারিত হলেও শিক্ষার্থীদের সুবিধা অনুসারে পরিবর্তনের সুযোগ থাকে। খ. বিশেষ কোনো লক্ষ্য কিংবা যোগ্যতা অর্জনে সহায়তার উদ্দেশ্যে পরিকল্পিত ও পরিচালিত হয়। গ. জীবনের যে কোনো বয়সে এ শিক্ষা লাভের সুযোগ থাকে। যেমন বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত শিক্ষা।
৩. আনুষ্ঠানিক শিক্ষা:
আনুষ্ঠানিক শিক্ষা হচ্ছে কাঠামোগত শিক্ষা। শিক্ষার্থী নির্দিষ্ট বয়সে এরূপ শিক্ষার্জন শুরু করে এবং ধাপে ধাপে স্বীয় যোগ্যতা প্রমাণ সাপেক্ষে শিক্ষার বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা জীবন শেষ করে। আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সাথে স্কুল, মাদ্রাসা, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্পৃক্ত। বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার কয়েকটি স্তর রয়েছে। যেমন: ক) প্রাথমিক স্তর, খ) মাধ্যমিক স্তর, গ) উচ্চ মাধ্যমিক স্তর, এবং ঘ) উচ্চ শিক্ষা।
শিক্ষার ভূমিকা বা কার্যাবলি (Role or functions of education)
সমাজজীবনে শিক্ষার ভূমিকা বিভিন্ন দিক থেকে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তবে শিক্ষার উদ্দেশ্য বা ভূমিকা প্রসঙ্গে দার্শনিক ও সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে ব্যাপক মতানৈক্য রয়েছে। অনেকের মতে ব্যক্তি-মানুষের মানসিক উন্নতি সাধনই হল শিক্ষার উদ্দেশ্য। গ্রিক দার্শনিক প্লেটো এবংএরিস্টটলের মতে শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য হল জ্ঞানার্জন। এখানে শিক্ষার ভূমিকা বা কার্যাবলি সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো:
১। সু-প্রবৃত্তিসমূহের বিকাশ সাধন: শিক্ষার উদ্দেশ্য হল মানুষের প্রকৃতি প্রদত্ত প্রবণতাগুলোকে বিকশিত করা এবং মানুষের মনে আদর্শ চিন্তা জাগ্রত করা। মানুষের সুপ্ত মানসিক শক্তি বা বুদ্ধিবৃত্তি বিকশিত হয় শিক্ষার মাধ্যমে।
২। ত্রুটিপূর্ণ মনোবৃত্তির সংশোধন: শিক্ষা মানুষের মনোভাব ও আচরণের ত্রুটি দূর করে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে অনেক ভ্রান্ত ধারণা এবং অসামাজিক মনোবৃত্তি বর্তমান থাকে। এগুলোর সংশোধনেও শিক্ষার বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।
৩। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বাহক: শিশুকে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিত করে শিক্ষা। দেশ ও সমাজের অতীত, এর সঙ্গীত-সাহিত্য, শিল্প-দর্শন, ধর্ম ইত্যাদি জ্ঞান আহরণ করে শিক্ষার মাধ্যমে।
৪। প্রতিযোগিতামূলক মনোভাবের সৃষ্টি: বিদ্যায়তনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় সুর্নিদিষ্ট পাঠ্যক্রম থাকে। এ পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন বিষয়ের উপর পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়। মূল্যায়নের মাধ্যমে যারা উচ্চ স্থান অধিকার করে তারাই কৃতিত্বের দাবিদার হয়। এ প্রক্রিয়ায় তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব গড়ে উঠে।
৫। শিক্ষার পেশাগত ভূমিকা: পেশার ক্ষেত্রে শিক্ষার ভূমিকা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তিকে জীবিকা অর্জনে সক্ষম করে তােলার ক্ষেত্রে শিক্ষার ভূমিকা অনেকখানি। শিক্ষা ব্যাক্তিকে নির্দিষ্ট কোনো পেশার জন্য বিশেষভাবে প্রস্তুত করে তােলে।
৬। সামাজিকীকরণে শিক্ষার ভূমিকা: শিশুর জন্মের পর থেকে ক্রমশ সমাজের উপযুক্ত নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার মূলে শিক্ষার ভূমিকা সর্বাধিক। সামাজিক আচার-আচরণ, বিশ্বাস, মূল্যবোধ যেমন সমাজ থেকে অর্জিত হয়, তেমনি বিশেষ জ্ঞান, ব্যবহারিক ও প্রায়ােগিক দক্ষতা ইত্যাদি অর্জনে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ভূমিকা রাখে।
৭। রাজনৈতিক সচেতনতা তৈরি: শিক্ষা সমাড়স্থ ব্যক্তিবর্গকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করে তােলে। রাষ্ট্র পরিচালনা, আইন প্রণয়ন, নীতি নির্ধারণ, প্রতিনিধি নির্বাচন ইত্যাদি ক্ষেত্রে সচেতনতা তৈরির মূলে শিক্ষার ভূমিকা অনস্বীকার্য। শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গই জনমত তৈরিতে ভূমিকা রাখে। ৮। স্তরবিন্যাসের ক্ষেত্রে ভূমিকা: সমাজের যোগ্যতম ব্যক্তিবর্গকে বাছাই করার ব্যাপারে শিক্ষা সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। ফলে অধিকতর যোগ্য ব্যক্তিবর্গ সমাজে বিশেষ মর্যাদায় আসীন হন। শিক্ষার মাপকাঠিতে অনেকের পদ ও পদমর্যাদা নির্ধারিত হয়। তৈরি হয় সামাজিক অসমতা ও স্তরবিন্যাস। ৯। সাংস্কৃতিক উৎকর্ষ ও সভ্যতা বিনির্মাণে শিক্ষার ভূমিকা: আজকের সমাজ পরিবর্তনের ফসল। এ পরিবর্তনের মূলে মানুষের শিক্ষালব্ধ জ্ঞান সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। উৎপাদন ব্যবস্থার উৎকর্ষ, সাংস্কৃতিক উন্নয়ন, সভ্যতার অগ্রগতির মূলে কাজ করেছে মানুষের শিক্ষা। ১০। আত্মবিশ্বাস ও বিচার-বিবেচনাবোধ: শিক্ষা মানুষের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ও বিচার-বিবেচনার ক্ষমতা জাগ্রত করে। সমাজজীবনে মানুষের ব্যক্তিত্ব, আত্মমর্যাদাবোধ, ভালো-মন্দের পার্থক্য উপলব্ধির ক্ষমতা নির্ধারণ করে শিক্ষা।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions