প্রতিষ্ঠান কি
প্রতিষ্ঠান (Institution )
সামাজিক প্রতিষ্ঠান সমাজবিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যয়। সমাজ জীবনের নানাবিধ কর্মকাণ্ড ও জটিলতা সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই প্রকাশ পায়। মানুষের বিভিন্ন প্রয়োজন পূরণের জন্যই প্রতিষ্ঠানের উদ্ভব হয়। তবে প্রতিষ্ঠান শুধু মানুষের প্রয়োজনই পূরণ করে না, মানুষের ক্রিয়াকর্মকেও নিয়ন্ত্রণ করে। প্রতিষ্ঠান হচ্ছে সমাজবদ্ধ মানুষের মাঝে প্রতিষ্ঠিত প্রথাপদ্ধতি, যা পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে গড়ে উঠে। প্রতিষ্ঠান বলতে সাধারণত, কতকগুলো প্রতিষ্ঠিত কার্যপ্রণালীকে বুঝায়। সমাজে যদি প্রতিষ্ঠিত কার্যপ্রণালী, রীতি-নীতি না থাকত, তাহলে মানুষ সুশৃঙ্খলভাবে সমাজে বাস করতে পারত। না। কাজেই সমাজে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মানুষ সুষ্ঠুভাবে জীবন যাপন করতে পারে। তাই বলা যায় প্রতিষ্ঠান হলো সামাজিক কাঠামোর এমন উপাদান যার মাধ্যমে মানুষ প্রয়োজন মিটানোর জন্য বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম সংগঠিত, নিয়ন্ত্রিত ও বাস্তবায়ন করে।
সুসংবদ্ধ সমাজ জীবন মানুষের কাম্য। মানুষ তার গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনের বিভিন্ন প্রয়োজন পূরণের জন্য সমাজে কতগুলো নিয়ম-কানুনের সৃষ্টি করে। এ ধরনের প্রতিষ্ঠিত নিয়মনীতিকে প্রতিষ্ঠান বলে। কেননা প্রতিষ্ঠিত নিয়মনীতি ভিন্ন সমাজ জীবন কখনো সুষ্ঠু ও সুশৃংখলভাবে পরিচালিত হতে পারে না। যেমনঃ ‘বিবাহ' নামক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই ‘পরিবার’ গড়ে ওঠে। যদি বিবাহের মাধ্যমে পরিবারের সৃষ্টি না হত তাহলে নারী-পুরুষের সমন্বয়ে সুশৃঙ্খল ও নিয়ন্ত্রিত সমাজ গড়ে উঠত। ফলে সমাজে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা দেখা দিত।
ম্যাকাইভার ও পেজ তাঁদের ‘Society' নামক গ্রন্থে প্রতিষ্ঠানের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন যে, “প্রতিষ্ঠান হলো সে সব প্রতিষ্ঠিত কর্মপদ্ধতি যার মাধ্যমে গোষ্ঠীর কার্যাবলীর বৈশিষ্ট্য সূচিত হয়।” সমাজবিজ্ঞানী জিসবার্ট প্রতিষ্ঠান বলতে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণের জন্য কতকগুলো স্থায়ী ও স্বীকৃত কর্মপদ্ধতিকে বুঝিয়েছেন।
সুতরাং প্রতিষ্ঠান হচ্ছে প্রচলিত বিধি-বিধান ও কর্মপন্থা, যা দীর্ঘকাল যাবৎ সমাজে প্রচলিত।
প্রতিষ্ঠানের ধরনসমূহ (Types of Institution)
সমাজে বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যেমন:
১। পারিবারিক প্রতিষ্ঠান: পরিবার সমাজ জীবনের আদি ও সর্বজন স্বীকৃত একটি সামাজিক দল। বিবাহ ও ব্যক্তি সম্পর্কের ভিত্তিতে স্বামী-স্ত্রী, পিতা-মাতা, ভাই-বোন, সন্তান-সন্ততিসহ মানুষ যেখানে একত্রে বসবাস করে তাকেই পরিবার বলে। পরিবারের পূর্বশর্ত হলো বিবাহ। পারিবারিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, কোর্টশিপ উল্লেখযোগ্য।
২। অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান: ম্যাক্স ওয়েবারের মতে, যেসব মৌলিক ব্যবস্থা ও নিয়মকানুন পণ্য উৎপাদান, ভোগ ও বন্টন। সংক্রান্ত কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করে থাকে - তাকেই অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান বলে। মানুষ আদিম যুগ থেকেই অর্থনৈতিক জীবন আরম্ভ করেছে। মানব সভ্যতার বিভিন্ন পর্যায়ে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও সমাজ কাঠামো পরিবর্তন ঘটেছে। সম্পত্তি হচ্ছে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। তবে আধুনিক কালে ব্যাংক, বীমা, সমবায় ও ঋণদান সংস্থা ইত্যাদিকেও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ্য করা যায়। কারণ, সমাজস্থ মানুষের সম্পত্তি ও সম্পদ এসব সংগঠনের মাধ্যমেই সুরক্ষিত ও প্রসার লাভ করে।
৩। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান: রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মানুষ তার রাজনৈতিক কর্মকান্ড সম্পাদন করে। সমাজের সকল প্রকার রাজনৈতিক কর্মকান্ড অধিকাংশই রাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। রাষ্ট্র তার বিভিন্ন বাহনের মাধ্যমে সমাজের আইন-শৃংখলা রক্ষা, শাসন ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ, আইন-প্রণয়ন, নাগরিকদের অধিকার ও কর্তব্য নির্ধারণসহ অনেক দায়িত্ব পালন করে। আধুনিক কালের মতো প্রাচীন গ্রিক নগর রাষ্ট্রে রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করা হয়নি। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের উদাহরণ হচ্ছে, সংসদ, ভোট, নির্বাচন প্রভৃতি।
৪। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান: ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সমাজ জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ধর্ম হল সর্বজনীন ও প্রাচীন প্রতিষ্ঠান। প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ নানাভাবে ধর্মের সংগে সম্পর্কযুক্ত। সমাজবিজ্ঞানীগণ মনে করেন যে, কতকগুলো সামাজিক আচার অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়েই ধর্মের উৎপত্তি হয়েছে। মধ্যযুগে সমাজ ও রাষ্ট্র ধর্ম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতো। ধর্মীয় রীতি-নীতি, মূল্যবোধ, প্রথা-প্রতিষ্ঠান এখনো মানুষের সমাজ জীবনকে বহুলাংশে নিয়ন্ত্রণ করে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মসজিদ, মন্দির, গির্জা, নামাজ, রোজা, উপাসনা, পূজা অর্চনা উল্লেখযোগ্য।
৫। শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠান: শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য হলো ব্যক্তির মধ্যে সুপ্ত বুদ্ধি, মেধা ও নৈতিক ক্ষমতাগুলোকে বিকশিত করে তার ব্যক্তিত্বকে গড়ে তোলা। শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব ও চরিত্র চরিত্র গঠন করে। যৌক্তিকতা এবং পেশাগত দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে শিক্ষা ব্যক্তিকে তার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে যোগ্য করে তোলে। স্কুল, মাদ্রাস, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, ক্লাস, পরীক্ষা, প্রভৃতি হলো শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠানের উদাহরণ।
৬। সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান: সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে মানুষের সৃজনশীল বুদ্ধিমত্তার বিকাশ ও প্রকাশ ঘটে। সমাজ প্রবাহের সঙ্গে মানুষের মধ্যে যে জ্ঞান ও বিচার বুদ্ধির সৃষ্টি হয় তার উৎকর্ষ সাধনের জন্য নানাবিধ সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানেরও উদ্ভব হয়েছে এবং এসব সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই মানুষের সৃজনশীল কর্মকান্ড সুষ্ঠুভাবে সম্পাদিত হয়। সাহিত্য সংঘ, সঙ্গীত পর্ষদ ও নাট্য সংঘ হল সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের এক একটি দৃষ্টান্ত।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions