বিবাহ কি
বিবাহের মাধ্যমে একজন মহিলা ও একজন পুরুষ পারিবারিক জীবন শুরু করার প্রথম সোপানে পা দেয়। শুধু তাই নয় এই সম্পর্কের মাধ্যমে একজন পুরুষ ও একজন মহিলা সমাজস্বীকৃতভাবে সন্তান জন্মদানের অধিকার লাভ করে। সামাজিক নৃবিজ্ঞানী এডওয়ার্ড ওয়েস্টারমার্ক এর মতে বিবাহ নারী-পুরুষের মধ্যকার কম বেশি স্থায়ী একটি সম্পর্ক বিশেষ, যা সন্তান জন্মদানের পরও অব্যাহত থাকে। এছাড়া বিবাহ একটি আইনানুগ ও জনমতের স্বীকৃতিসম্মত বন্ধুত্বের বহিঃপ্রকাশ।
সমাজবিজ্ঞানী ল্যান্ডবার্গ তাঁর Foundations of Sociology (1956) গ্রন্থে বিবাহের সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে, বিবাহ হচ্ছে এমন কতকগুলো নিয়মনীতি ও আইন-কানুন, যা স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক অধিকার, দায়িত্ব-কর্তব্য এবং সুযোগ সুবিধাকে সংজ্ঞায়িত করে (Marriage consists of rules and regulations which define the rights, duties and privileges of husband and wife, with respects to each other.)।
সমাজবিজ্ঞানী হর্টন এবং হান্ট এর মতে, বিবাহ হচ্ছে একটি অনুমোদিত সামাজিক ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে দুই কিংবা ততোধিক ব্যক্তি একটি পরিবার প্রতিষ্ঠা করতে পারে (Marriage is the approved social pattern whereby two or more persons establish a family)
Lucy Mairএর মতে, বিবাহ হচ্ছে একজন পুরুষ ও একজন মহিলার সমাজস্বীকৃত এমন যুগল বন্ধন যার মাধ্যমে ঐ মহিলা যেসব সন্তানের জন্ম দেবে সেসব সন্তান বিবাহিত ঐ পিতা-মাতার বৈধ সন্তানের স্বীকৃতি লাভ করবে।
স্কট (W. P. Scott) তাঁর Dictionary of Sociology গ্রন্থে বিবাহের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন বিবাহ হলো এমন একটি অনুষ্ঠান কিংবা সামাজিক রীতি নীতির এক জটিল রূপ যা একজন পুরুষ ও একজন মহিলাকে পারস্পরিক অধিকার ও কর্তব্যের বন্ধনে আবদ্ধ করে এবং যা পারিবারিক জীবন পরিচালনায় অপরিহার্য ("Marriage is an institution or complex of social norms that sanctions the relationship of a man and woman and binds them in a system of mutual obligations and rights essential to the functioning of family life")
সুতরাং বিবাহ হচ্ছে সমাজস্বীকৃত একজন পুরুষের সাথে একজন মহিলার এমন একটি যুগল বন্ধন, যার মাধ্যমে ঐ পিতামাতা পিতৃত্বের এবং মাতৃত্বের অধিকারী হয়।
মূলত বিবাহ হচ্ছে সমাজ, সংস্কৃতি ও ধর্ম কর্তৃক অনুমোদিত একটি চুক্তি যার মাধ্যমে একজন পুরুষ এবং একজন মহিলা একত্রে বসবাস করার বৈধ ক্ষমতা লাভ করে, যার ফলে পরিবার গঠনের প্রাথমিক ধাপ শুরু হয় এবং পরস্পরের মাঝে অধিকার ও কর্তব্যের বিকাশ ঘটায়।
বিবাহের প্রকারভেদ
সমাজ পরিবর্তনের সাথে সাথে বিবাহ ব্যবস্থাতেও এসেছে পরিবর্তন। আদিম সমাজ থেকে বর্তমান সমাজের বিবাহ পদ্ধতি ভিন্ন। শিক্ষার প্রসার, বিজ্ঞানের উন্নয়ন, সাংস্কৃতিক পরিবর্তন, ধর্মীয় মূল্যবোধ ইত্যাদি কারণে বিবাহের প্রকারভেদের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য লক্ষ করা যায়। এই বৈচিত্র্যের ভিত্তিতেই সামাজিক নৃবিজ্ঞানীরা বিবাহের ভিন্নতার কথা বলেছেন। যেমন: একক বিবাহ, বহু স্ত্রী বিবাহ, বহু স্বামী বিবাহ, গোষ্ঠী বিবাহ, শ্যালিকা বিবাহ ইত্যাদি।
একক বিবাহ (Monogamy)
একক বিবাহ প্রথায় একজন পুরুষ একই সময়ে একজন মহিলাকে বিবাহ করতে পারে। এটি পৃথিবীর বহুল প্রচলিত বিবাহ পদ্ধতি এবং সর্বজনস্বীকৃত। এজন্য নৃবিজ্ঞানী ম্যালিনোস্কীর মতে, Monogamy is, has been, and will remain the only true type of marriage. অর্থাৎ একক বিবাহ পদ্ধতি হচ্ছে সর্বকালের জন্য যথার্থ ব্যবস্থা। কেবল উন্নত সমাজেই নয়, শিকার ও খাদ্য সংগ্রহমূলক অর্থনীতির সমাজেও কম বেশি একক বিবাহ রীতির প্রচলন ছিল বলে কোনো কোনো নৃবিজ্ঞানী মনে করেন।
বহুস্ত্রী বিবাহ (Polygyny)
Polygyny শব্দটি গ্রীক ভাষা থেকে আগত, যার অর্থ একাধিক মহিলা'। বহুস্ত্রী বিবাহ প্রথায় একজন পুরুষের সাথে একাধিক মহিলার বিবাহ হয়ে থাকে। বহুস্ত্রী বিবাহ এবং বহুস্বামী বিবাহ দুটিই বহু বিবাহের দুইটি ভিন্ন রূপ। এস্কিমো এবং আফ্রিকার নিগ্রোদের ভেতর বহুস্ত্রী ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। উপমহাদেশের মুসলমান এবং হিন্দু সমাজেও এ ধরনের বিবাহ ব্যবস্থা প্রচলিত আছে। কৃষি নির্ভর সমাজে অর্থনৈতিক কাজকর্মের সুবিধার জন্য বহুস্ত্রী গ্রহণের প্রচলনের উদাহরণ ভারতীয় উপমহাদেশের সমাজে রয়েছে।
বহুস্বামী বিবাহ (Polyandry)
পৃথিবীর কোনো কোনো অঞ্চলে এ ধরনের বিবাহ ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। এ ধরনের বিবাহ ব্যবস্থায় একজন নারী একই সাথে একাধিক পুরুষের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। তবে এটা খুব বিরল ঘটনা। তিব্বতে বহুস্বামী বিবাহ প্রথা ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। দুই ধরনের বহুস্বামী প্রথা লক্ষ্য করা যায়। যথা-ভ্রাতৃত্বমূলক (Fraternal) এবং অভ্রাতৃত্বমূলক (Non-fraternal)। প্রথমটিতে সকল সহোদর মিলে একজন নারীকে বিবাহ করে আর দ্বিতীয়টিতে বিবাহিত মহিলার স্বামীরা পরস্পর ভাই নয়।
একাধিক শ্যালিকাবিবাহ
বহুস্ত্রী বিবাহের একটি বিশেষ রূপ হলো একাধিক শ্যালিকা বিবাহ । এর মাধ্যমে একজন পুরুষ কোনো পরিবারের একাধিক কন্যাকে বিয়ে করে। রেডইন্ডিয়ানদের মধ্যে দেখা যায় যে, স্ত্রীরা যদি পরস্পর বোন হয় তবে তারা একই তাবুতে বসবাস করে। আর স্ত্রীরা যদি পরস্পর বোন না হয় হয় তাহলে তারা ভিন্ন ভিন্ন তাবুতে বসবাস করে।
দলগত বিবাহ
যে বিবাহ ব্যবস্থায় একাধিক পুরুষ ও একাধিক মহিলার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় তাকে দলগত বিবাহ বলে। এ ধরনের বিবাহ খুব কম দেখা যায়। তিব্বত এবং শ্রীলংকার সমাজে প্রচলিত বহুস্বামী গ্রহণ রীতি ধীরে ধীরে দলগত বিবাহ রীতিতে পর্যবসিত হতে দেখা যায়। তিব্বতীয় সমাজে দেখা যায় যে, ভ্রাতৃত্বমূলক বহুস্বামী গ্রহণের (Fraternal Polyandry) ক্ষেত্রে একজন মহিলার যৌথ স্বামীরা (স্বামীরা পরস্পর ভাই) সন্তান লাভে ব্যর্থ হলে তারা আরেকটি স্ত্রী গ্রহণ করতে। তবে এক্ষেত্রে তাদের আগের স্ত্রীকে বন্ধ্যা হতে হবে।
ভ্রাতৃ-বিধবা বিবাহ
কোনো মহিলার স্বামী মারা গেলে ঐ মৃত স্বামীর ভাইয়ের সাথে ঐ মহিলার বিবাহ হলে তাকে ভ্রাতৃবিধবা বিবাহ বা লেভিরেট বলে। এ প্রথাটি যেন ভ্রাতৃত্বমূলক বহুস্বামী গ্রহণের (Fraternal Polyandry) একটি বিশেষ রূপ। এ ধরনের ব্যবস্থায় কোনো মহিলার দুজন স্বামী পরস্পর ভাই সম্পর্কের ।
শ্যালিকা বিবাহ বা সরোরেট
কোনো পুরুষের স্ত্রী মারা গেলে ঐ মৃত স্ত্রীর বোনের সাথে ঐ পুরুষের বিবাহ হলে তাকে শালিকা বিবাহ বা সরোরেট বলে। এটি একাধিক শ্যালিকা বিবাহেরই একটি বিশেষ রূপ। এ ধরনের বিবাহ প্রথা আমাদের সমাজে বেশ প্রচলিত।
বহির্বিবাহ
বিবাহের ক্ষেত্রে যদি কে নো পুরুষ বা মহিলা তার নিজ গোষ্ঠীর বাইরে থেকে পাত্র/পাত্রী নির্বাচন করে তখন বহির্বিবাহ বলে। পাত্র বা পাত্রী যে গোষ্ঠীর সদস্য সে গোষ্ঠীর বাইরে অন্য গোষ্ঠী থেকে পাত্র/পাত্রী নির্বাচন করতে হয়। এ ধরনের বিবাহ ব্যবস্থার আরো কতক নাম পর্যবেক্ষণ করা যায়। যেমন: বহির্গোষ্ঠী, বহির্গোত্র এবং বহিগ্রাম বিবাহ। উত্তর ভারতে একজন ব্যক্তিকে নিজ গ্রামের বাইরে বিয়ের পাত্রী খুঁজতে হয়। অতএব এর নাম বহির্গাম বিবাহ (Village Exogamy)।
অন্তবিবাহ
বিবাহের ক্ষেত্রে যদি কোনো পুরুষ বা মহিলাকে তার নিজ গোষ্ঠীর ভেতরে থেকে পাত্র/পাত্রী নির্বাচন করে তখন তাকে অন্তবিবাহ বলে। পাত্র বা পাত্রী যে গোষ্ঠীর সদস্য সে গোষ্ঠীর মধ্য থেকে তাকে পাত্র/পাত্রী খুঁজতে হবে। পাঁচ প্রকারের অন্তর্বিবাহ রয়েছে। যথা: উপজাতীয় অন্তর্বিবাহ, জাতি বর্ণ ভিত্তিক অন্তর্বিবাহ, শ্রেণিমূলক অন্তর্বিবাহ, উপজাত বর্ণ ভিত্তিক অন্তর্বিবাহ ও নরগোষ্ঠীগত অন্তবিবাহ।
প্যারালাল কাজিন বিবাহ।
প্যারালাল কাজিন হলো চাচাত ভাইবোন বা খালাত ভাইবোন। অর্থাৎ একই লিঙ্গের ভাইয়ের সন্তানেরা বা বোনের সন্তানেরা পরস্পর প্যারালাল কাজিন। চাচাত ভাইবোনের মধ্যে অথবা খালাত ভাইবোনের মধ্যে বিবাহকে বলা হয় প্যারালাল কাজিন বিবাহ। বাংলাদেশের মুসলিম সমাজসহ পৃথিবীর অনেক সমাজেই প্যারালাল কাজিন বিবাহ প্রথা প্রচলিত।
ক্রস কাজিন বিবাহ
বিপরীত লিঙ্গের অর্থাৎ ভাই এবং বোনের সন্তানেরা ক্রস কাজিন। পিতার বোনের সন্তান-সন্ততি ( বা ফুপাত ভাইবোন) এবং মাতার ভাইয়ের সন্তান-সন্ততি (বা মামাত ভাইবোন) হলো ক্রস কাজিন। এ ধরনের বিবাহ বাংলাদেশের মুসলিম সমাজে প্রায়ই দেখা যায়।
অনুলোম বিবাহ
উঁচু বর্ণের হিন্দু পাত্রের সঙ্গে নিচু বর্ণের হিন্দু পাত্রীর বিবাহকে অনুলোম বিবাহ (Hypergamy) বলে। ভারতের গুজরাট ও কেরালায় এর উদাহরণ পাওয়া যায় ।
প্রতিলোম বিবাহ
নিচু বর্ণের হিন্দু পাত্রের সঙ্গে উঁচু বর্ণের হিন্দু পাত্রীর বিবাহকে প্রতিলোম বিবাহ (Hypogamy) বলে। ভারতে এ ধরনের বিবাহ একেবারে বিরল নয়।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions