সামাজিক নিরাপত্তা কি
সামাজিক নিরাপত্তা
একটা দেশে বসবাসরত মানুষের আর্থিক অবস্থা একই রকম হয় না। একটা অংশ আর্থিকভাবে খুব সচ্ছল হতে পারে আবার কোনো অংশ হয়ত আর্থিক বিবেচনায় খুব অসচ্ছল। অসচ্ছল জনগোষ্ঠী তাদের দৈনন্দিন জীবন যাপনের মৌলিক চাহিদা মেটাতে পারে না। এ কারণে তাদেরকে সহায়তা করার জন্য সবদেশের সরকারই কিছু না কিছু পরিকল্পনা থাকে। এ ধরনের একটা পরিকল্পনার নাম হলো সামাজিক নিরাপত্তা পরিকল্পনা।
সম্প্রতি বাংলাদেশে অর্থনৈতিক মানদন্ডে এবং জীনযাপনের মানদন্ডের সাধারণ মানুষের বেশ অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। তবে দেশের মোট জনবসতির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এখনো দারিদ্র সীমার নিচে অবস্থান করছে। এসব দরিদ্র এবং হতদরিদ্র মানুষদের সহায়তাদানের জন্য বাংলাদেশ সরকারের নানামুখী পরিকল্পনা রয়েছে। বাংলাদেশ বর্তমানে যেসব সামাজিক নিরাপত্তা পরিকল্পনা (Social Safety Net) চালু রয়েছে সেগুলোকে মোটামুটি চার ভাগে ভাগ করা যায় (১) নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি কর্মসূচি; (২) দুর্যোগ এবং অন্যান্য বিপত্তির সাথে খাপ খাইয়ে নেবার মত পরিকল্পনা; (৩) সন্তানের শিক্ষা প্রদানে সহায়তা করার জন্য পিতামাতাদেরকে প্রদেয় সরকারি ভর্তুকি ব্যবস্থা; (৪) পরিবারের সদস্যদের স্বাস্থ্য সেবার লক্ষ্যে সরকারি ভর্তুকি কার্যক্রম। সাহায্য প্রদানের ধরন অনুযায়ী সামাজিক নিরাপত্তাকে দুভাগে ভাগ করা যেতে পারে(ক) সরাসরি নগদ টাকা প্রদান করা এবং (খ) খাদ্য প্রদান করা।
সরকারি এই প্রচেষ্টার ফলে দেখা গেছে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মেয়েদের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। শিক্ষায় জেন্ডার পার্থক্য কমেছে, গ্রামাঞ্চলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি সম্ভব হচ্ছে, বিভিন্ন দুর্যোগে খাদ্য সহায়তা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে, অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে, মাতৃ স্বাস্থ্য সেবা বেড়েছে, সরকারের স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম বিস্তৃত হয়েছে। সরকারের গৃহীত সামাজিক নিরাপত্তা পরিকল্পনার চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো বঞ্চিত মানুষের অধিকার নিশ্চিত করা-যাতে তারাও এক সক্ষম জনগোষ্ঠীতে রূপান্তরিত হতে পারে।
১৬ কোটির অধিক মানুষের এই ছোট দেশে সব মানুষের সুযোগ সৃষ্টি করা সহজ কাজ নয়। এ জন্য দরকার এক শক্তিশালী অর্থনীতির, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন কার্যক্রম বাংলাদেশে এখনো পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। আবার জনসংখ্যার একটা বড় অংশ চরম দারিদ্রের মধ্যে রয়েছে বলে তারা অর্থনীতিতে শক্ত কোন ভূমিকা রাখতে পারছে না। এই দুর্বলতম অংশকে মূলধারায় ফিরিয়ে আনার জন্য বাংলাদেশ সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা পরিকল্পনাগুলো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।
সীমিত সম্পদ এবং সীমিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণে বাড়তি জনসংখ্যার চাপকে প্রায়শই সামাল দেওয়া সম্ভব হয় না। নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, খরা, নদীভাঙন ইত্যাদি নানা কারণে গ্রাম থেকে বহুমানুষ জীবিকার আশায় শহরমুখী হয়। একারণে শহরে বস্তি গড়ে উঠছে। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৩০ ভাগই শহরবাসী অথচ বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য সুযোগ সৃষ্টি করাও সব সময় সম্ভব হয়ে উঠে না। গ্রামের মানুষকে গ্রামে ধরে রাখার জন্য এবং উৎপাদন বাড়াবার জন্য সরকার কৃষিতেও ভর্তুকি দিচ্ছে। দৈনিক ক্যালরি গ্রহণের ভিত্তিতে ১৯৮৮-৮৯ সময়ে দারিদ্রের হার ছিল শতকরা ৪৭ ভাগ। সরকারের সাম্প্রতিক প্রচেষ্টার ফলে গ্রামীণ ও শহুরে দারিদ্র্য উভয়েই কমানো সম্ভব হয়েছে।
সামাজিক নিরাপত্তা পরিকল্পনা
বাংলাদেশ সরকার বর্তমানে দারিদ্র দূরীকরণে উন্নয়ন পরিকল্পনার শীর্ষে ঠাই দিয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারের লক্ষ্য হলো ২০২১ সালের মধ্যে দারিদ্রের মাত্রা শতকরা ১৫ ভাগে নামিয়ে আনা। এক্ষেত্রে ধারণা করা হচ্ছে অবকাঠামোগত বিনিয়ােগ, যেসব মৌসুমে কাজ থাকে না সেসব মৌসুমে অতিরিক্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা এবং সেই সাথে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর পরিধি বাড়ানোর মাধ্যমে দারিদ্রের হার লক্ষণীয় মাত্রায় কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। এক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিতে হবে তাদেরকে যারা চরম দারিদ্র সীমার নিচে রয়েছে, দরিদ্র নারীদেরকে, ভূমিহীন এবং অন্যান্য বঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে। একটি শক্তিশালী এবং বিস্তৃত সামাজিক নিরাপত্তা পরিকল্পনাই পারে দারিদ্রকে পুরোপুরি নির্মূল করতে। সরকারের লক্ষ্য সেটাই।
সরকারের অর্থবাজেট ও পরিসংখ্যানে তাই সামাজিক নিরাপত্তার গুরুত্বকে তুলে ধরা হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী (Social Safety Net) র আওতায় চার ধরনের উদ্যোগ গৃহীত হয়েছে: (১) সমাজের বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ বরাদ্দের ব্যবস্থা করা, যাতে করে গরীব ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠী দারিদ্রকে ভালভাবে সামাল দিতে পারে; (২) ক্ষুদ্রঋণ এবং অন্যান্য তহবিল গঠনমূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে কর্মক্ষেত্র ও চাকুরির নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি করা; (৩) খাদ্য নিরাপত্তাভিত্তিক কার্যক্রম-যাতে করে প্রাকৃতিক দুর্যোগ পরবর্তী সমস্যাদি অঞ্চলভেদে তারা নিজেরাই সমাধান করতে পারে এবং (৪) শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং ট্রেনিং এর পরিধি বাড়ানো যাতে নতুন প্রজন্মকে আরো বেশি করে সক্ষম এবং স্বনির্ভরশীল হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব হয়।এর আওতায় এ টাকা ব্যয় হবে কয়েকটি ক্ষেত্রে, এর মধ্যে রয়েছে Food For Works (FFIV') বা কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি, Vulnerable Group Feeding (VGF), Gratuitious Relief (G R Food), এবং চট্টগ্রামে পাহাড়ী অঞ্চলে খাদ্য সহায়তা প্রদান। বয়স্কভাতার পরিধিও বাড়ানো হয়েছে।
সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর উদ্যোগ, পরিকল্পনা এবং তার বাস্তবায়ন ধারাবাহিকভাবে প্রত্যেক নির্বাচিত সরকারই করে থাকে। এর লক্ষ্য থাকে সামাজিক ঝুঁকি মোকাবিলা, দারিদ্র দূরীকরণ এবং দুর্বলতম জনগোষ্ঠীকে সক্ষমতার পথ দেখিয়ে তাদেরকে উন্নয়নের মূল ধারায় সম্পৃক্ত করা।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions