রাষ্ট্র কি
আদিম সমাজে মানুষ যখন যূথবদ্ধ সমাজে বসবাস করত তখনও তারা একজন নেতার নেতৃত্বে সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত হত। স্বাস্থ্য, সক্ষমতা, বয়স, লিঙ্গ, শক্তি ইত্যাদি বিবেচনায় নেতা নির্বাচিত হত। নেতা নির্বাচন, নেতার প্রতি আনুগত্যতা ইত্যাদির মধ্য দিয়েই মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ ঘটেছে। মানব সমাজ ক্রমবিকাশের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ক্রমশ জটিল রূপ ধারণ করেছে। রাষ্ট্র তেমনই এক জটিল রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রের ধারণা, এর উপাদান ও বৈশিষ্ট্য এবং উৎপত্তি সম্পর্কে মনীষীরা নানা মত ব্যক্ত করেছেন।
রাষ্ট্রের সংজ্ঞা (Definition of state)
রাষ্ট্র যেমন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, তেমনি সামাজিক প্রতিষ্ঠানও। রাজনৈতিক সমাজতন্ত্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় হচ্ছে রাষ্ট্র। Gillin and Gillin রাষ্ট্রের দুটি বিশেষ স্বরূপ উদ্ঘাটন করেছেন। “গঠনতন্ত্রের পটভূমিতে রাষ্ট্র, গঠনতন্ত্রে প্রতিফলিত রাষ্ট্র।” রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব প্রথম স্বরূপকে সামনে রেখে রাষ্ট্রকে মূল্যায়ন করে। সব দেশের গঠনতন্ত্রই সেদেশের সমাজ, সামাজিক কাঠামো, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ইত্যাদি বিষয়ের পটভূমিতে তৈরি হয়।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে রাষ্ট্রের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা দিয়েছেন অধ্যাপক গার্নার (Garner)। তিনি বলেছেন, রাষ্ট্র কম-বেশি এমন একটি জনসমষ্টি যারা একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে স্থায়িভাবে বসবাস করে, যারা বহিঃশক্তির নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত এবং যাদের একটি সংগঠিত সরকার আছে যার প্রতি তারা স্বভাবতই আনুগত্য প্রদর্শন করে। (“State is a community of persons, more or less numerous permanently occupying a definite portion of territory, independent or nearly so of external control and possessing an organized government to which the great body of inhabitants render habitual obedience").
ম্যাক্স ওয়েবারের মতে, রাষ্ট্র হল সুনির্দিষ্ট পদ্ধতির মাধ্যমে রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রদানের একটি সংঘ। ম্যাকাইভার ও পেজের মতে, অন্যান্য সংঘের সাথে রাষ্ট্রের পার্থক্য হল শক্তি প্রয়োগের চরম ক্ষমতা একমাত্র রাষ্ট্রেরই কর্তৃত্বাধীন। সরোকিন (P. A. Sorokin) বলেছেন, রাষ্ট্র হল তার কর্তৃত্বাধীন জনগণের সকল গোষ্ঠীর পারস্পরিক সম্পর্ক তত্ত্বাবধান ও চাপ প্রশমনের সংগঠন।
অতএব, রাষ্ট্র হচ্ছে জনগণকে সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনা করার একটি শক্তিধর ও সার্বভৌম সংগঠন। জনগণের সার্বিক কল্যাণ সাধন ও সামাজিক শৃঙ্খলা বিধান হচ্ছে রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান কাজ।
রাষ্ট্রের উপাদান ও বৈশিষ্ট্য (Elements and Characteristics of state)
রাষ্ট্রের প্রধানত চারটি উপাদান রয়েছে। যথা:
১। জনসসমষ্টি (Population): জনসসমষ্টি নিয়েই রাষ্ট্র। এ জন্য জনসংখ্যাকে রাষ্ট্রের প্রাথমিক উপাদান বা বৈশিষ্ট্য বলে। অভিহিত করা হয়। তবে জনসংখ্যার কোনো সুনির্দিষ্ট পরিমাণ নেই। রাষ্ট্রভেদে জনসংখ্যা কম বা বেশি হতে পারে।
২। নির্দিষ্ট ভূখণ্ড (Territory): রাষ্ট্রের সীমারেখা অবশ্যই ভৌগোলিকভাবে নির্ধারিত থাকে। সেজন্য রাষ্ট্রের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো এর নির্দিষ্ট ভূখণ্ড। নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে স্থায়িভাবে বসবাসকারী জনসংখ্যা রাষ্ট্র গড়ে তোলে।
৩। সরকার (Government): জনসংখ্যাকে রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় সংগঠিত করা, তাদের কল্যাণ সাধন, দেশের সার্বভৌমত্ব এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য প্রতিটি রাষ্ট্রের অপরিহার্য উপাদানের নাম সরকার।
৪। সার্বভৌম ক্ষমতা (Sovereignty): সার্বভৌম ক্ষমতা হচ্ছে নৈর্ব্যক্তিক ও নিরংকুশ ক্ষমতা। এর দ্বারা রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা এবং বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করা যায়।
উপর্যুক্ত উপাদানগুলো রাষ্ট্রের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য হিসেবেও বিবেচিত।
রাষ্ট্রের আরোকিছু বৈশিষ্ট্য নিচে উল্লেখ করা হলো:
ক) রাষ্ট্র একটি সামাজিক সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান। এটি সমাজের অংশ, তবে সমাজ রাষ্ট্রের অংশ নাও হতে পারে। রাষ্ট্রের
ভৌগোলিক পরিসীমা আছে, সমাজের ক্ষেত্রে এটি বাধ্যতামূলক নয়।
খ) জনগণের কল্যাণ সাধন এবং তাদেরকে সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনা রাষ্ট্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
গ) নির্দিষ্ট ভূখণ্ড ও এর অধিবাসীদের সার্বিক নিরাপত্তার লক্ষ্যে একটি সার্বভৌম সরকার থাকা রাষ্ট্রের জন্য বাঞ্ছনীয়।
ঘ) অন্যান্য সামাজিক নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ও স্বার্থ-গোষ্ঠীর সাথে রাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান রয়েছে।
ঙ) সমাজবিজ্ঞানী নাজমুল করিমের মতে, সহযোগিতা এবং অবদমন (Domination) রাষ্ট্রের প্রধান দুটি বৈশিষ্ট্য।
চ) রাষ্ট্র বিবর্তন প্রক্রিয়ায় সামাজিক সংগঠনের পরিপক্ব এবং একটি চূড়ান্ত স্তর। মানব সংগঠনের একটি বিশেষ পর্যায়ে এসে রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটেছে।
রাষ্ট্রের কার্যাবলি (Functions of state)
রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রাষ্ট্রের কার্যাবলিকে প্রধানত দু'ভাগে বিভক্ত করেছেন। যথা: ক) অত্যাবশ্যকীয় কাজ (Essential functions) এবং খ) ঐচ্ছিক কাজ (Optional functions)।
ক) রাষ্ট্রের অত্যাবশ্যকীয় কাজ:
যেসব কাজ রাষ্ট্রের অস্তিত্বের জন্য খুবই জরুরি সেগুলো হলো রাষ্ট্রের অত্যাবশ্যকীয় কাজ। রাষ্ট্রের অত্যাবশ্যকীয় কাজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে:
০১) রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিধান রাষ্ট্রের প্রথম কাজ হলো বহিঃশক্তির আক্রমণ কিংবা অহেতুক হস্তক্ষেপ থেকে নিজেকে রক্ষা করা। প্রয়োজনে যুদ্ধ বা সন্ধির পথ বেছে নেওয়া। সামরিক শক্তির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
০২) নাগরিকের নিরাপত্তা বিধান রাষ্ট্রের কাজ হলো নাগরিকের আইনগত অধিকার ও কর্তব্য সুনিশ্চিত করা। কর প্রদান, রাষ্ট্রীয় আইন ও বিধি-বিধান মেনে চলতে নাগরিকদের বাধ্য করার প্রাথমিক দায়িত্ব রাষ্ট্রকেই পালন করতে হয়। রাষ্ট্র ও সরকারের প্রতি নাগরিকদের অনুগত রাখার ব্যবস্থা নেওয়া রাষ্ট্রের অন্যতম জরুরি কাজ।
০৩) জনগণের অধিকার রক্ষা: সব নাগরিকের জন্য সমান অধিকার এবং আইনের শাসন নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী দ্বারা যেন অন্য কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী শোষিত, বঞ্চিত বা অত্যাচারিত না হয় সে দিকে লক্ষ রাখা রাষ্ট্রের জরুরি কাজের অংশ। জনগণের মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার রক্ষার দায়িত্বও রাষ্ট্রের।
খ) রাষ্ট্রের ঐচ্ছিক বা গৌণ কাজ:
বর্তমানে রাষ্ট্রের ঐচ্ছিক কাজগুলো এতই গুরুত্ব পাচ্ছে যে, রাষ্ট্রের অত্যাবশ্যকীয় কাজ ও ঐচ্ছিক কাজের মাঝে ভেদরেখা টানা খুবই কষ্টকর। রাষ্ট্রের ঐচ্ছিক কাজকে অসমাজতান্ত্রিক (non-socialistic) এবং সমাজতান্ত্রিক (socialistic) নামে বিভক্ত করা হয়। অসমাজতান্ত্রিক কাজগুলো রাষ্ট্রের জন্য অত্যাবশ্যকীয় নয়, কিন্তু খুবই স্বাভাবিক। যেমন: দরিদ্র এবং অক্ষমদের যত্ন নেওয়া, জনহিতকর কাজ, সেনিটেশন, প্রাথমিক শিক্ষা, পরিসংখ্যান গ্রহণ ও গবেষণা-কর্ম সম্পাদন, ডাক বিভাগীয় কাজ, রাস্তাঘাট, সেতু নির্মাণ, খাল খনন ব্যবসা বাণিজ্যের সুবিধাদি প্রদান ইত্যাদি অসমাজতান্ত্রিক কাজ বলে বিবেচিত।
রাষ্ট্রের সমাজতান্ত্রিক কাজগুলোর মধ্যে রেলপথ, টেলিগ্রাফ, টেলিফোন, গ্যাস, পানি এবং বিদ্যুত প্রভৃতি সেবাধর্মী কাজ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়া থিয়েটার, বিশ্ববিদ্যালয়, যাদুঘর, চাকরি, পেনশন এবং অন্যান্য এমন সব কাজ যা সমাজ উন্নয়নমূলক এবং যা সমাজের সুযোগ-সুবিধা ও সম্পদের সুষম বন্টনের নিশ্চয়তা দেয়।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions