ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা কাকে বলে
ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি: ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি সাধারণভাবে বাজার অর্থনীতি বা অবাধ উদ্যোগ বা অবাধ-নীতি অর্থনীতি হিসেবেও পরিচিত। ধনতান্ত্রিক অর্থনীতিতে মৌলিক অর্থনৈতিক সমস্যাসমূহ বাজার শক্তির অবাধ ক্রিয়ার মাধ্যমে সমাধান করা হয়। এই অর্থ ব্যবস্থায় অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে রাষ্ট্রের কোন ভূমিকা থাকে না বা নগণ্য ভূমিকা থাকে। যথাযথভাবে বলতে গেলে বিশুদ্ধ বাজার অর্থনীতি বা অবাধ-নীতি অর্থনীতি কখনও বিদ্যমান ছিল না। সমাজে যখনই কোন রাজনৈতিক সংগঠন ছিল তখনই তা কিছু কিছু অর্থনৈতিক কাজ সম্পাদন করেছে (যেমন, মূল্য নিয়ন্ত্রণ বা কর আরোপ)। বিশুদ্ধ বাজার অর্থনীতি একটি আদর্শ অবস্থা এবং আমাদের জানা দরকার এটি কিভাবে কাজ করে।
ধনতান্ত্রিক বা বাজার অর্থব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য
ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্য নিচে সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলঃ
১. ব্যক্তিগত সম্পত্তি
ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিকানা ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। এ অর্থব্যবস্থায় ভূমি, দালান কোঠা, যন্ত্রপাতি এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক ও মানুষ নির্মিত সম্পদের মালিকানার, নিয়ন্ত্রণের ও বিলিবন্দেজ করার অধিকার ব্যক্তি বা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের হাতে থাকে।
২. পছন্দ ও উদ্যোগের স্বাধীনতা
উদ্যোগের স্বাধীনতা বলতে বুঝায় যে ব্যক্তিগত উদ্যোক্তা অর্থনৈতিক সম্পদ কেনা ও ভাড়া নেয়া, এই সকল সম্পদ সংগঠিত করে পছন্দমত দ্রব্য ও সেবা উৎপাদন করা এবং উৎপাদিত দ্রব্য ও সেবা পছন্দমত বাজারে বিক্রয় করার ক্ষেত্রে স্বাধীন। কোন শিল্পে প্রবেশ বা প্রস্থানের ক্ষেত্রে কোন উদ্যোক্তার জন্য সরকার বা অন্য উৎপাদক কোন কৃত্রিম বাধা বা প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে না।
পছন্দের স্বাধীনতা বলতে বুঝায় যে, ভূমি ও মূলধনের মালিকেরা যেভাবে উপযুক্ত মনে করে সেভাবে এসব সম্পদ ব্যবহার করতে পারে। শ্রমিকেরা তাদের যোগ্যতা অনুসারে পেশা বাছাই ও ত্যাগ করতে পারে। সর্বোপরি ভোক্তা তাদের পছন্দ অনুযায়ী খরচ করতে পারে। ভোক্তার স্বাধীনতা অর্থনৈতিক স্বাধীনতার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়। ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় ভোক্তাকে প্রভূ বিবেচনা করা হয়। কারণ ভোক্তা যে সব দ্রব্য ও সেবা ক্রয়ের জন্য ব্যয় করে সমাজের সম্পদ সেসব দ্রব্য ও সেবা উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত হয়।
৩. স্বার্থের ভূমিকা
ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা ব্যক্তিবাদী এবং এজন্য এরূপ অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হল ব্যক্তি স্বার্থের উন্নতি সাধন। প্রত্যেক অর্থনৈতিক একক তার নিজের জন্য যা সবচেয়ে ভাল তা করে। ফার্ম এমনভাবে উৎপাদন করে যাতে তার মুনাফা সর্বোচ্চ হয় (বা ক্ষতি নূন্যতম হয়)। ভূমি ও মূলধনের মালিক এসব সম্পদ এমন ক্ষেত্রে ব্যবহার করে যা থেকে সবের্বাচ্চ পারিতোষিক পাওয়া যায়। শ্রমিক তার পেশা ও কর্মস্থল এমনভাবে পছন্দ করে যাতে সে সর্বোচ্চ মজুরি পায়। ভোক্তা এমনভাবে তার আয় ব্যয় করে যাতে সে সর্বোচ্চ কিস্তি লাভ করে। বাজার অর্থনীতির প্রবক্তাগণ যেমন এ্যাডাম স্মীথ, যুক্তি দেখান যে ব্যক্তি স্বার্থের উন্নতিবিধানের চেষ্টা সর্বোচ্চ সামাজিক কল্যাণ বয়ে আনে।
৪. প্রতিযোগিতা
অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা প্রতিযোগিতা ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য। প্রতিযোগিতা বলতে মূলতঃ দাম প্রতিযোগিতা বুঝায়। দ্রব্য বা উপকরণের বাজারে অসংখ্য ক্রেতা এবং বিক্রেতা থাকে। কোন একজন ক্রেতা বা বিক্রেতা বাজারের তুচ্ছ অংশ অর্থাৎ মোট ক্রয় বা বিক্রয়ের তুলনায় তার ক্রয় বা বিক্রয়ের পরিমাণ খুব অল্প। সুতরাং সে এককভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। মোট চাহিদা ও যোগানের মিথ ক্রিয়ার মাধ্যমে বাজারে দাম নির্ধারিত হয় এবং এই দাম প্রদত্ত ধরে ক্রেতা ও বিক্রেতা সিদ্ধান্ত নেয়। তত্ত্বগতভাবে, প্রতিযোগিতা ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণমূলক কৌশল। এটি অর্থনৈতিক ক্ষমতার প্রয়োগ সীমিত করে। কারণ, কোন একক ফার্ম বা ব্যক্তি বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।
৫. বাজার এবং দাম
ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার সর্বাপেক্ষা মৌলিক বৈশিষ্ট্য হল বিভিন্ন ব্যবহারের মধ্যে সম্পদ বরাদ্দকরণে মূল্য প্রক্রিয়ার ব্যবহার। বিভিন্ন দ্রব্য ও উপকরণের ক্রেতা ও বিক্রেতাদের সিদ্ধান্ত বাজার ব্যবস্থার মাধ্যমে কার্যকরি হয়। ক্রেতাদের সিদ্ধান্ত দ্বারা চাহিদা এবং বিক্রেতাদের সিদ্ধান্ত দ্বারা যোগান নির্ধারিত হয়। চাহিদা এবং যোগানের মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে বাজারে দাম নির্ধারিত হয়। এই দাম সম্পদের মালিক, উদ্যোক্তা এবং ভোক্তাদের জন্য পথনির্দেশক স্তম্ভ হিসেবে কাজ করে যার ভিত্তিতে তারা সিদ্ধান্ত নেয় এবং নিজস্ব স্বার্থ সিদ্ধির জন্য সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে। যেমন, কোন দ্রব্যের দাম বাড়লে ঐ দ্রব্যটি উৎপাদন করা বেশী লাভজনক হয় এবং ফলে উৎপাদকেরা দ্রব্যের যোগান বাড়ায়।
দাম রসদবন্টন কৌশল হিসেবে কাজ করে। অর্থনৈতিক দ্রব্য দুষ্পাপ্য। এসব দুস্প্রাপ্য দ্রব্যের যারা চাহিদা সৃষ্টি করে দাম তাদের মধ্যে দ্রব্য সংবিভাগ করে। কোন দ্রব্যের যোগানের তুলনায় চাহিদা বেশি হলে দ্রব্যটির দাম বৃদ্ধি পায়। যারা বেশি দাম দিতে সক্ষম নয় তারা বাজার থেকে সরে যায়। যারা বেশি দিতে সক্ষম তারা দুস্প্রাপ্য দ্রব্যটি পেতে সক্ষম হয়। উল্লেখ্য যে, দাম প্রয়োজন বা অভাব অনুসারে দ্রব্য সংবিভাগ করে না বরং দাম প্রদানের ক্ষমতা অনুসারে দ্রব্য সংবিভাগ করে।
৬. সরকারের সীমিত ভূমিকা
প্রতিযোগিতামূলক ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি সম্পদের ব্যবহার বা বরাদ্দকরণে সর্বাপেক্ষা দক্ষ। তাই এরূপ অর্থনীতির কার্যপরিচালনার জন্য বস্ত্ততপক্ষে সরকারের কোন ভূমিকা নেই। এক্ষেত্রে ব্যক্তিগত সম্পত্তির ব্যবহার এবং ব্যক্তির পছন্দের সীমারেখা টানার জন্য সরকার শুধু যথাযথ আইন কাঠামো দিতে পারে। যেমন, নিজস্ব সম্পদ ব্যবহার করে মাদক দ্রব্য উৎপদানের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions